পাহাড়ে শান্তিচুক্তি ইস্যুতে সশস্ত্র তৎপরতা

%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a7%9c%e0%a7%87-%e0%a6%85%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a6%be%e0%a6%b0

কাজী সোহাগ, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে: 
শান্তিচুক্তি ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে শুরু হয়েছে নতুন করে বিতর্ক। আগে বিষয়টি নিয়ে যুক্তি-তর্ক দিয়ে বিতর্ক করা হলেও এখন যোগ হয়েছে সশস্ত্র তৎপরতা। এ নিয়ে পাহাড়ের তিন উপজাতি সংগঠনের মধ্যে দেখা দিয়েছে চাঞ্চল্য। নতুন করে শান্তিচুক্তিকে ইস্যু করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য। এতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা সম্ভব বলে মনে করছে সশস্ত্র সংগঠনের নীতিনির্ধারকরা। সম্প্রতি তিন পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টেও একই তথ্য জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এতদিন শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে উপজাতি বিভিন্ন সংগঠন নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে এসেছে। কিন্তু এখন তারা চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ততটা তৎপর নয়। উল্টো পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো শুরু করেছে। এ নিয়ে নানা রকম তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

বিশেষ করে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালি ও উপজাতিদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বিপুল অংকের চাঁদা। তা দিয়ে সশস্ত্র গ্রুপকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। গোপনে বিদেশ থেকে কেনা হচ্ছে ভারি, দামি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র। সামরিক আদলে কাঠামো তৈরি করে নিজেদের সংগঠিত করছে। অন্যদিকে তিন পার্বত্য জেলাকে অস্ত্রের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা।

এতে নিজেদের অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি দেশে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িতদের কাছে বিক্রি করছে ভারি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র। এর মাধ্যমে আর্থিকভাবে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে পাহাড়ে তৎপর জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র গ্রুপরা।

পাহাড়ে শান্তিচুক্তি বিতর্ক প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ এই এলাকায় গত চার দশকের বেশি সময় ধরে অস্থিতিশীল করে রেখেছে জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন। তাদের দাবি এই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কিন্তু দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ গঠন হলে দেশের কোনো সার্বভৌমত্ব থাকে না। তাই কোনো সরকারই তাদের এই অন্যায় দাবি মেনে নেয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পাহাড়িদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। চুক্তির পরে দীর্ঘ ১৯ বছর পাহাড়ে মোটামুটি শান্তির সুবাতাস বইছিল। এই চুক্তির ৭২টি দফার মধ্যে ৪৮টি দফার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি দফাগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

ধরতে গেলে উপজাতিদের দেয়া দফাগুলোর সবই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হঠাৎ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জেএসএস, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারপন্থি গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাস থেকে পাহাড়ে এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার কারও সাহস নেই। যদি জানতে পারে কেউ অভিযোগ করেছে- তাহলে পরের দিন তার লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে অথবা অপহরণ করা হচ্ছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এসব খবর বেশিরভাগ সময়ই মিডিয়ায় আসে না।

শান্তি চুক্তি বিতর্ক প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী চাচ্ছে পাহাড়ে যেন শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হয়। এ নিয়ে তারা ইস্যু করতে চায়। চুক্তি নিয়ে সন্তু লারমার ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চুক্তি নিয়ে অসন্তোষ সন্তু লারমার থাকতে পারে। অন্যদের নেই। সন্তুর দাবি সরকার আমাকে ডাকে না কেন। আমার বক্তব্য হচ্ছে সরকারকে ডাকতে হবে কেন। আপনি সরকারের কাছে যেতে পারেন না। সমস্যাটা আসলে আপনার।

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, চুক্তির ১৯ বছর পার হয়েছে। এই ১৯ বছরে সন্তু লারমা যদি সরকারের কাছে ১৯ বারও যেতো তাহলে চুক্তির ১৯টি সমস্যার সমাধান হতো। তিনি তা করেননি। এদিকে চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে ভূমি, বন ও পুলিশের ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের এ ধরনের যুক্তির বিরোধিতা করেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান। বন, ভূমি ও পুলিশি ক্ষমতা চাওয়া মানেই সার্বভৌমত্ব চাওয়া। আমি মনে করি ভূমি হস্তান্তর করা কখনও ঠিক নয়। রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি আঞ্চলিক পর্যায়ে দেয়া যেতে পারে না। তিনি বলেন, চুক্তিটি পরিশীলিত করা উচিত বলে মনে করি।

এদিকে পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে তিন উপজাতি সংগঠনের সশস্ত্র সদস্যরা। এর মধ্যে ইউপিডিএফ ও জেএসএস অনেকটা প্রকাশ্যে নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে চাঁদা চেয়ে দেয়া চিঠিতে বলা হচ্ছে- সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের পুর্নস্থায়িত্ব শাসন অর্জন সম্ভব বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিজয় আমাদের অনিবার্য।

গোয়েন্দারা জানান, পার্বত্য এলাকার মানুষের মাঝে এখন বিরাজ করছে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চাঁদা আতঙ্ক। বেশির ভাগ ভুক্তভোগী চাঁদার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে স্বীকার করেন না। কারণ দুর্গম এলাকা হওয়ায় পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর পক্ষে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের পাশাপাশি উপজাতীয়দের কাছেও এখন আতঙ্কের নাম চাঁদাবাজি। পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে নিয়মিত কাজ করেন এমন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও চাঁদাবাজির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।

এ নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলকেও জানানো হয়েছে। সেখানে চাঁদার সুনির্দিষ্ট হিসাবও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বছরে এ তিন জেলায় শুধু চাঁদা তোলা হয় ৪০ কোটি ২৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঁদা তোলা হয় খাগড়াছড়িতে।

এদিকে চাঁদা তোলার পাশাপাশি উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। এসব অস্ত্র মজুদ করে সশস্ত্র তৎপরতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এম কে-১১, জার্মানীর তৈরি এইচ কে-৩৩, রাশিয়ার জি-৩, একে-৪৭, একে-২২, এম-১৬ রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, চাইনিজ সাব মেশিনগান, এসবিবিএল বন্দুকের মতো অস্ত্র রয়েছে সশস্ত্র উপজাতিদের হাতে। এসবই বিদেশি অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিয়মিত এসব অতাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে। মানের দিক দিয়ে এসব অস্ত্র যেমন অত্যাধুনিক তেমনি দামের দিক দিয়েও ব্যয়বহুল। এমকে-১১এর মতো অত্যাধুনিক রাইফেল দিয়ে প্রায় এক মাইল দূর থেকেও নিশানা করা যায়। এর কার্যকরী রেঞ্জ এক হাজার ৫শ গজ। প্রতি মিনিটে ফায়ার করা যায় ৭৫০ রাউন্ড। একটি নতুন এমকে রাইফেলের দাম প্রায় ৮ লাখ টাকা।

স্থানীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, পাহাড়িদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্র এখন পৌঁছে যাচ্ছে দেশে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গিদের হাতে। ব্যবহার হচ্ছে দেশ বিরোধীসন্ত্রাসী কাজে। সম্প্রতি পার্বত্য এলাকা ঘুরে জানা গেছে, অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার কারণে পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে।

পাহাড়ে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমারা সংখ্যায় বেশি। সরকারের দেয়া সব সুযোগ-সুবিধা এই তিন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষই ভোগ করছেন।

বাকি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ দরিদ্র ও নিরীহ। তারা পাহাড়ে কৃষি কাজ করেই জীবনযাপন করেন। তাদের মধ্যে পাহাড় স্বাধীন করার কোন চিন্তা কাজ করে না। তারা জানেনও না সরকার পাহাড়িদের জন্য লেখাপড়া, সরকারি চাকরিসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য শতকরা ৫ ভাগ কোটা রয়েছে।

পাহাড়ে শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা। এরপরই মারমা ত্রিপুরার স্থান। ম্রো নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে শিক্ষার ভিত তৈরি হচ্ছে। তবে চাকমাদের তুলনায় খুবই কম। তঞ্চ্যঙ্গা, বম, পাঙ্খুয়া, চাক থিয়াং, খুমি, লুসাই ও কোচদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই নগণ্য।

এসব জাতি গোষ্ঠীর মানুষ কৃষিকাজ, বন থেকে লাকড়ি, কলাসহ বনজ ফলমূল সংগ্রহ করে। এগুলোই বাজারে বিক্রি করে জীবনযাপন করছেন। বাঙালিদের মতোই তাদের অবস্থান। তারা কখন চিন্তাও করে না পাহাড়ে কী ধরনের শাসন হবে। জীবন বাঁচাতেই সারাদিন কেটে যায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে।

খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় বর্তমানে ৫১ ভাগ পাহাড়ি বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী আর ৪৯ ভাগ বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস। দেশের এক-দশমাংশ এলাকায় মাত্র ১৬ লাখ লোক বসবাস করছে।

– সূত্র: মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন