শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারাদেশ

Untitled-110

(আট)

রাঙামাটিতে হরতাল পালনকারীদের উপর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের সহযোগিতায় চাকমা সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল(বর্তমানে আমীর) মাওলানা নিজামী ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৭ এক বিবৃতিতে বলেন-
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি জাতীয় পার্টিসহ ৭টি দলের আহবানে সাড়া দিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলাসমূহে হরতাল সফল করায় আমি জনগণকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি এবং হরতাল চলাকালে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের সহযোগিতায় চাকমা সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় হামলা চালিয়ে জামায়াতে ইসলামির অফিস, আল আমীন এতিমখানা, মোজাদ্দেদে আল ফেসানি একাডেমী, মাদ্রাসায়, বনরূপা জামে মসজিদ ভাংচুর ও ৫০জনকে আহত করা, খাগড়াছড়িতে পার্বত্য সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদের ১০/১২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার, মাটিরাঙাতে ২জনকে অপহরণ ও চট্টগ্রামে ৪/৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ  জানাচ্ছি। সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে- হরতাল আহবান ও পালন করা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকারে বাঁধা দান অন্যায়।

আওয়ামী লীগ সরকার তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সাথে দেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন, অখণ্ডতা ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি সম্পাদন করেছে। এ চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সাড়ে লক্ষাধিক বাঙালির অস্তিত্ব ও নাগরিকত্বকেই অস্বীকার করা হয়েছে। তারা বাঁচার দাবিতে সংগ্রাম করছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও নাগরিক হিসেবে বাঁচার জন্যই তারা হরতাল পালন করতে বাধ্য হয়েছে। গতকাল হরতাল চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টায় রাঙামাটিতে চাকমা সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ও পুলিশের সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামির অফিসে, মোজাদ্দেতে আল ফেসানী একাডেমীতে, আল আমীন এতিমখানায়, মাদ্রাসায় ও বনরূপা জামে মসজিদে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে এবং প্রায় ৫০জনকে আহত করেছে। তারা হরতাল পালনকারীদেরকে যাকে পেয়েছে তাকেই মারধর করেছে। তাদের হামলায় রাঙামাটি জেলা জামায়াতে ইসলামির আমীর এএসএম শহিদুল্লাহ, সেক্রেটারী আবুল কালাম ইঞ্জিনিয়ার, ইসলামি ছাত্র শিবিরের নেতা মোহাম্মদ ইউনুস, মোস্তাফিজুর রহমান, নিয়াজুদ্দিন, জামশেদুর রহমান, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা আব্দুল গফুরসহ ৫০জন আহত হয়েছে।

বেলা সাড়ে এগারটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত অব্যাহতভাবে এ সন্ত্রাস চলতে থাকে। এ সময় রাঙামাটির ডিসি, এসপি ও ওসির সাথে বারবার যোগাযোগ করা সত্ত্বেও তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছে। অপরপক্ষে পুলিশ সন্ত্রাসীদের সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে। আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যাপারেও পুলিশ অপারগতা প্রকাশ করে। পরে সেনাবাহিনীর জীপে করে আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। প্রশাসনের এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক। গতকাল হরতাল চলাকালে পুলিশ খাগড়াছড়িতে পার্বত্য সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদের নেতা আব্দুল অদুদসহ ১০/১২জনকে এবং চট্টগ্রামে ৪/৫জনকে গ্রেফতার করেছে।

নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি বাতিল, রাঙামাটি জেলা জামায়াতে ইসলামির অফিসে, আল আমীন এতিমখানা, বনরূপা জামে মসজিদ, মাদ্রাসা ও মোজাদ্দেদে আল ফেসানী একাডেমীতে হামলাকারী চাকমা সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার এবং হরতালচলাকালে গ্রেফতারকৃত পার্বত্য সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি প্রদান ও মাটিরাঙাতে অপহরণকৃত দু’জনকে উদ্ধার করার জন্য আমি সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। সেইসাথে আজকেও চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে সর্বাত্মক হরতাল পালনের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি দলমত নির্বিশেষে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলা সমূহের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলা সমূহের জনগণের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসী সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের কার্য নির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে দলীয় নেতারা মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ঐ দিন সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু। ঐ সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের জন্য তেহরান থাকায় আমু দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ঐ সভায় মূল আলোচ্য বিষয় ছিল শান্তি চুক্তি নিয়ে বিএনপিসহ ৭ দলীয় জোটের আন্দোলন। ঐ সভায় শান্তি চুক্তি নিয়ে দলের বেশ কয়েকজন নেতা প্রকাশ্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, তড়িঘড়ি করে শান্তি চুক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই বিষয়টি নিয়ে পার্বত্য জেলাসমূহে যে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে তার দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। তারা এই বলে যুক্তি দেখান যে, যেহেতু চুক্তিতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অথবা সংবিধান পরিপন্থী কিছু নেই বলে সরকার বিশ্বাস করে সেহেতু তা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করলে বিরোধী দল অথবা জাতীয় পার্টি বাইরে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারতো না। এটা সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই বিরোধী দলকে আন্দোলনের ইস্যু সৃষ্টি করে দিয়েছে।

ঐ বৈঠকে অনেক নেতাই ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকার শান্তি চুক্তির পর চুক্তির পক্ষে প্রচারণা চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো শান্তি চুক্তি বিরোধী প্রচারণা যেভাবে চালিয়েছে সরকার তা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সভায় উপস্থিত সংসদের চিফ হুইপ এবং পার্বত্য বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে কয়েকজন সদস্য উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, এই ব্যর্থতার দায়ভার তাকে বহন করতে হবে। শান্তি চুক্তি হবার এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও তিনি দলীয় নেতাদের চুক্তির পক্ষে কি বলতে হবে তা বুঝাতে পারেননি। এমনকি দলীয় নেতাদের কাছে চুক্তির কপিও সরবরাহ করা হয়নি।

দলীয় নেতাদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, শিগগিরই আপনাদের চুক্তির কপি বন্টন করা হবে। একই সাথে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির অনুষ্ঠিত ১৮টি বৈঠকের কাগজপত্রও সরবরাহ করা হবে। যা থেকে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরাও জনগণের মধ্যে থেকে বিভ্রান্তি দূর করতে সক্ষম হবে। চিফ হুইপ শান্তি চুক্তির পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। তিনি দলীয় নেতাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, মন্ত্রিসভার সদস্যগণ, সংসদ সদস্যগণ, এমনকি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ ব্যাপারে সারাদেশে গণসংযোগ করবেন। তিনি নিজেও জনমত থেকে ভীতি ও বিভ্রান্তি দূর করবেন। মন্ত্রিরাও বসে থাকবেন না। তবে এ ব্যাপার দলীয় নেতাদের করণীয় আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐ সভায় বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করার শাসকদলের নেতারা রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নেন। সভায় উপস্থিত মন্ত্রিরা বলেন, তারা প্রশাসনিকভাবে এই শান্তি চুক্তির বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্যদিকে ঐ সভার সভাপতি আমির হোসেন আমু কেন্দ্রীয় নেতাদের পার্বত্য এলাকা সফরসহ বিএনপির রাজপথের কর্মসূচি রাজপথে নেমেই মোকাবিলা করার নির্দেশ দেন। সভাপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অনেকেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির আহবান জানালে তোপের মুখে তা উড়ে যায়। ফলে বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রতিটি আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টির জন্য শাসকদল থেকে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করার বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পাশাপাশি সমগ্র পার্বত্য অঞ্চল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিএনপিসহ চারদলীয় জোট পার্বত্যবাসীর আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে পার্বত্য অঞ্চল তখন মূলতঃ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা তিন পার্বত্য জেলার যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই হাজার হাজার জনতার বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের মুখে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। কালো পতাকা ও ঝাড়– মিছিলের মুখোমুখি হয়েছে। আন্দোলন দমাতে সরকার নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সরকারের নির্দেশে মাটিরাংগায় বিক্ষুব্ধ জনতার উপর বৃষ্টির মতো গুলী ছোঁড়া হয়। এতে শহীদ হয় জাকির হোসেন ও গোলাম রসুল। শত শত আন্দোলনকারী জনতা আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। কিন্তু আন্দোলন দমানো যায়নি। সরকারের মন্ত্রীরা ফিরে যেতে বাধ্য হন। তিন পার্বত্য জেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে, দোকানে দোকানে, প্রতিষ্ঠানে এমনকি গাছে গাছে কালো পতাকা উড়েছে। গুলির মুখে কাফনের কাপড় পরে মানুষ মিছিলে অংশ নিয়েছে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির উদ্যোগে কলাবাগানস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত বিজয় দিবসের আলোচনা সভার সভাপতির ভাষণে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন-
 একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হলো, ‘আমি যেন সংবিধান আরেকবার পড়ি।’ পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি সই হওয়ার পর আমার দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয়, এই চুক্তি সংবিধানের পরিপন্থী। আমাদের দেশে সংবিধান বিশেষজ্ঞ বা সংবিধান বিশারদ কারা তা তারাই জানেন। আইনগতভাবে সুপ্রিমকোর্টই সাংবিধানিক বিতর্কের বিষয়ে প্রকৃত ব্যাখ্যা দিতে পারেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তি সংবিধান সম্মত না সংবিধানের পরিপন্থী তা ব্যাখ্যা করার জন্য আমি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে চুক্তিটি পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহবান জানাই। আপিল বিভাগ যে রায় দেন, তা আমরা মাথা পেতে নেব। আর যদি কোন সংশোধনী দেন, অবশ্যই তা গ্রহণের জন্যে সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হবে……আঞ্চলিক পরিষদ সুস্পষ্টভাবেই সংবিধানের পরিপন্থী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আছে এটি একটি একক সার্বভৌম রাষ্ট্র। যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়, তাহলে একক ও অখণ্ড রাষ্ট্র থাকে না। তাই আঞ্চলিক পরিষদ গঠন সংবিধান সম্মত নয়। এ নিয়ে যে সংঘর্ষ, হানাহানি ও রক্তের হোলি খেলা শুরু হয়েছে অবশ্যই তা বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্যেই পার্বত্য শান্তি চুক্তিটি সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগে পাঠানো জাতীয় জরুরি তাগিদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

১ জানুয়ারি ১৯৯৮ জাতীয় পার্টির দ্বাদশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভার সভাপতির ভাষণে এরশাদ পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিষয়ে পার্টির নীতি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা শান্তি চাই। কিন্তু পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে সংবিধানের পরিপন্থী যেসব ধারা আছে, আমরা তা মেনে নিতে পারি না। অবশ্যই এই চুক্তি সংসদে উত্থাপন করতে হবে এবং সংবিধান পরিপন্থী ধারাগুলো সংশোধন করতে হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে একটি লিখিত বক্তব্যে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান ও এসবের পরিপন্থী চুক্তির ধারা উদ্ধৃত করে পার্টির নীতি ব্যাখ্যা করেন। এরশাদ লিখিত বক্তব্যে বলেন-
আজকে এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে চুক্তির কোন কোন জায়গাগুলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ এবং কোন কোন জায়গা সংবিধান পরিপন্থী হয়েছে তা আমি আপনাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১

Bangladesh is a unitary, independent, sovereign, Republic to be known as the People’s Republic of Bangladesh. সুতরাং, আমরা এমন কোন কাজ করতে পারি না যা Unitary এর বিরুদ্ধে যেতে পারে। আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। আপনাদের অবশ্যই মনে আছে যে আমরা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর স্বার্থে প্রতিটি বিভাগে একটি করে হাইকোর্ট চালু করার জন্য সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী এনেছিলাম। ঢাকার গুটি কয়েক লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী আয়ের উৎস কমে যাওয়ার কারণে আমাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা শুরু করে এবং বিভিন্ন ভাষায় সমালোচনা করেন এবং এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। উক্ত রিটের জাজমেন্ট প্রদান করে হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারক বৃন্দ। বিচারকবৃন্দ হলেন বিচারপতি বি.এইচ চৌধুরী, বিচারপতি এম.এইচ রহমান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। একের অধিক হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠাকে সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন:

Justic B.H. Chowdhury: The amendment supports to create territorial units which eventually may claim the status of federaing units thereby destroying the very fabric of Unitaty Republic. In other words by showing the seeds of regionalism the next step can be dismantling the fabric of the Republic. (Para 238 of the Judgement)

Justic Shahabuddin Ahmed : Nor is it permissible to create a separate High Court under the Supreme Court as it will run counter to the unitary character of the state opening a door for ultimate distengration of the state. As to the unitary character of the state it is clear that in view of the homogeneity of her people having same language, culture, tradion and way of life within a small territory, the state has been so organised as a unitary state by its founding father leaving no scope for devaluation of executive, legislative and judicial powers on different regions to turn into provinces ultimately. (Para 361 and 362 of the judgement)

সুতরাং রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ১৯৮৯ সালে সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে দেশের একতা ও অখণ্ডতার উপর যে রায় দিয়েছেন, তিনি আজ দেশের একটি আঞ্চলিক পরিষদ সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের পরিপস্থী নয় একথা মেনে নেবেন কি করে?
সংবিধান ২৯ নং অনুচ্ছেদ: ২৯ (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
২৯ (২) কেবল ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
শান্তি চুক্তির ১৩, ১৪ ও ২৪ (ক) অনুচ্ছেদ সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। যদিও সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তথাপিও চুক্তির ধরণ উহা সমর্থন করে না বিধায় বিষয়টি আইনগত ব্যাখ্যার জন্য সুপ্রিমকোর্টে পাঠানো প্রয়োজন বলে মনে করি।
অনুচ্ছেদ ৬৫:
৬৫ (১) ‘জাতীয় সংসদ’ নামে বাংলাদেশ একটি সংসদ থাকবে এবং সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হবে।
তবে শর্ত থাকে যে, সংসদের আইন দ্বারা যে কোন ব্যক্তি বা কর্র্তৃপক্ষকে আদেশ, প্রবিধান, উপ-আইন বা আইনগত কার্যকারিতা সম্পন্ন অন্যান্য চুক্তির প্রণয়নের ক্ষমতার্পণ হতে এই দফার কোন কিছুই সংসদকে নিবৃত করবে না।”
সংবিধানের এই বিধান অনুসারেই আমরা সকলেই বলি সার্বভৌম সংসদ ইংরেজিতে ‘Sovereign Parliament’ কিন্তু আমরা শান্তি চুক্তির ৩২ অনুচ্ছেদ যদি দেখি তাহলে আমরা দেখতে পারবো যে, “পার্বত্য জেলায় প্রযোজ্য জাতীয় সংসদ বা জন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংগৃহীত কোন আইন পরিষদের বিবেচনায় উক্ত জেলার অন্য কার্যকর হইলে বা উপজাতীয়দের জন্য আপত্তিকর হলে পরিষদ তা কার্যকর বা আপত্তিকর হওয়ার কারণ ব্যক্ত করে আইনটির সংশোধন বা প্রয়োগ শিথিল করার জন্য সরকারের নিকট লিখিত আবেদন পেশ করিতে পারিবেন এবং সরকার এই আবেদন অনুযায়ী প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিবেন।”

সুতরাং চুক্তির উপরোল্লিখিত শর্তের প্রেক্ষিতে সংসদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করা হয়েছে। তাই বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের সবিনয় অনুরোধ জানাবো।
পবিত্র সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদের উল্লেখ আছে “সংসদের কোন আইনের দ্বারা বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যাবে না।
কিন্তু যখন আমরা শান্তি চুক্তির ২৭নং অনুচ্ছেদে এবং ৩৫ অনুচ্ছেদের (খ), (ঘ), (চ), (ঞ), (ট), (ঠ) প্রভৃতি অনুচ্ছেদগুলো পাঠ করি, তখন শান্তি চুক্তিতে সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং চুক্তির ২৭নং অনুচ্ছেদ পরিবর্তন অপরিহার্য।
সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “আইনগতভাবে প্রজাতন্ত্রের উপর ন্যস্ত যে কোন ভূমি বা সম্পত্তি ব্যতিত নিম্নলিখিত সম্পত্তিসমূহ প্রজাতন্ত্রের উপর ন্যস্ত হবে;
(ক) বাংলাদেশের যে কোন ভূমির অন্তঃস্থ সকল খনিজ ও অন্যান্য মূল্য সম্পন্ন সামগ্রী;
(খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্গত মহাসাগরের অন্তঃস্থ কিংবা মহিসোপানের উপরিস্থ মহাসাগরের অন্তঃস্থ সকল ভূমি, খনিজ ও অন্যান্য মূল্য সম্পন্ন সামগ্রী; এবং
(গ) বাংলাদেশে অবস্থিত প্রকৃত মালিক বিহীন যে কোন সম্পত্তি।
শান্তি চুক্তির ২৬ নং অনুচ্ছেদ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আমাকে শান্তি চুক্তির ২৬নং অনুচ্ছেদ বিস্মিত করেছে।
ক) উক্ত অনুচ্ছেদের উপ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, “আপাততঃ বলবৎ অন্য যে কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ কোন জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানোমদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়-বিক্রয় ও ইহার হস্তান্তর করা যাইবে না।
খ) আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও ইহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাইবে না।”
চুক্তির উপরের অংশটুকু সংবিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ১৪৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, “প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্বে সম্পত্তি গ্রহণ, বিক্রয়, হস্তান্তর, বন্ধক দান ও বিলি ব্যবস্থা, যে কোন কারবার বা ব্যবসা চালনা এবং যে কোন চুক্তি প্রণয়ন করা যাইবে।”
এটা কি সংবিধানের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন নয়? দেশের যারা বিবেকবান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই এদিকে নজর দেবেন। চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছেন সরকারের পক্ষে চিফ হুইপ জনাব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও এই সংসদের সদস্য। অপরজন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা জে.বি লারমা। কি অধিকার নিয়ে তিনি চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছেন? তিনি কি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি? না কোন গণ ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট প্রাপ্ত প্রতিনিধি? আমরা একজন বিচ্ছিন্নতাবাদীর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারি না।
সংসদে আলোচনার পরও সংবিধান পরিপন্থী কিনা তার ব্যাখ্যা দেবার জন্য সুপ্রিমকোর্টের মতামত গ্রহণের জন্য পুনরায় আহবান জানাই।

আওয়ামী লীগ সরকার যে চুক্তি করে তা বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, জাগপাসহ প্রভৃতি রাজনৈতিক দল শুধু যে প্রত্যাখ্যান করেছে তা নয়, সাথে সাথে তাদের বিরোধিতার ব্যাখ্যাও জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৯৮ সংবাদপত্রের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের কালো চুক্তি নিয়ে যে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে তার সারমর্ম হলোÑ
(১) সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র। কিন্তু চুক্তিতে রাষ্ট্রের এক কেন্দ্রীকতা দ্বি-খণ্ডিত করে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ নামে সর্বক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রদেশের চেয়েও বেশি ক্ষমতা এবং মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের ছয় লাখ বাংলাভাষীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিককে পরিণত করেছে।
(ক) পৃথিবীর যে কোন দেশ জমি কিনতে পারবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি কিনতে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’-এর অনুমোদন লাগবে, (খ) পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের ভোটার হতে হলে উপজাতীয় সার্কেলের সার্টিফিকেট লাগবে, (গ) পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে উপজাতিদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। ফলে বাংলাভাষীরা চাকরি পাবে না, (ঘ) কখনো কোনো বাংলাভাষী সর্ব-ক্ষমতাধর ‘আঞ্চলিক পরিষদ’-এর চেয়ারম্যান এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারবে না, (ঙ) কোনো বাংলাভাষী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হতে পারবে না।
(২) সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্বের প্রতীক। জাতীয় প্রয়োজনে প্রেসিডেন্ট দেশের যে কোন স্থানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’-এর অনুমোদন ছাড়া প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারবে না।
(৩) সেনাবাহিনীর অনেক স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার হবে। বাংলাভাষী-উপজাতী নির্বিশেষে শান্তি বাহিনীর জুলুমের শিকার হবে।
(৪) জাতীয় সংসদ সার্বভৌম এবং সব অঞ্চলের জন্য আইন প্রণয়নের অধিকারী। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কোনো আইন প্রণয়ন করতে হলে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’-এর পূর্ব অনুমোদন লাগবে।
(৫) সরকার যে কোন স্থানে জমি অধিগ্রহণের অধিকারী, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি অধিগ্রহণে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’-এর অনুমোদন লাগবে।
(৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ এবং এসআই পর্যন্ত নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে আঞ্চলিক পরিষদকে।
(৭) অস্ত্র সমর্পণকারীদের পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবেÑঅর্থাৎ অবৈধ অস্ত্রের বদলে তাদের হাতে বৈধ অস্ত্র তুলে দেয়া হবে।
(৮) পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যাক্স, খাজনা, টোল প্রভৃতি আদায় করবে ‘আঞ্চলিক পরিষদ।’
(৯) দেশের সকল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মালিক সরকার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্যাস-তেলসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ উত্তোলন করলে সরকারকে ‘আঞ্চলিক পরিষদকে’ খাজনা দিতে হবে। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এই দাবি তুলতে পারে।
১০) পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ সরকারের অনুমতি ছাড়াই বিদেশি অর্থ গ্রহণ করতে পারবে।
(১১) পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প স্থাপন করতে গেলে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’-এর অনুমোদন লাগবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারাদেশ”

  1. So called peace accord couldn’t bring peace rather it has created much more problems. Terrorism in CHT has been increased. No justice happened on ………………..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন