শরণার্থী শিবির সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ স্থানীয়দের: ক্ষুব্ধ রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা ক্যাম্প

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

কক্সবাজার সীমান্তের দুটি শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সরকারের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয়রা।কক্সবাজার পর্যটন উন্নয়নের কথা বিবেচনায় রেখে সরকার সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে উদ্যোগ গ্রহণ করে। অপরদিকে কক্সবাজার থেকে তাদের শিবির সরিয়ে না নেয়ার দাবি জানিয়েছে রোহিঙ্গারা। সেই সঙ্গে তৃতীয় কোনো দেশে স্থায়ীভাবে নিজেদের পুনর্বাসনেরও দাবি জানায় তারা।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা। এ সময় রোহিঙ্গারা তার কাছে এই দাবির কথা জানায়। তাদের দেশে প্রত্যাবাসন বা তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের কাজ প্রায় থমকে আছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মূলত দু’দফায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। একবার ১৯৭৮ সালে; আরেকবার ১৯৯২-৯৩ সালে। টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে রয়েছে ৩৩ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা। শরণার্থী শিবিরের পাশে গড়ে ওঠা আন রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বসতি দিন দিন বেড়েই চলছে। আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় আরো অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে থাকছে। বিশাল এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজারের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশের দুটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ ঘটছে রোহিঙ্গাদের। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন সমস্যা ঝুলে থাকায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের দু’টি ক্যাম্পে অবস্থানরত শরণার্থী অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়ায় অবস্থিত দু’টি আর্ন্তজাতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প।

ইউএনইচসসিআরের কক্সবাজারের অফিস সূত্র মতে, এ ক্যাম্প দুটিতে বর্তমানের প্রায় ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। অপরদিকে আরআরসি অফিস এর মতে দুটি শিবিরে দুই হাজার ৯৬৯টি পরিবারের ২৫ হাজার ৮৫২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তবে এ দুটি ক্যাম্পের সঙ্গে লাগোয়া দুটি আন রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে রয়েছে এক লাখ মতো আন রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা। সর্বশেষ ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই দুজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছিল।

এ নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মধ্যে অনেক কূটনৈতিক দেন-দরবার হয়েছে, তারপরও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। এছাড়া টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত ৩০ হাজার আর উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এক লাখ অনিবন্ধিত এবং কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবৈধ বসবাস করছে। রাখাইন প্রদেশে বার বার রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইনদের মধ্যে দাঙ্গা সৃষ্টি হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা। এসব রোহিঙ্গার কোনো পরিচয়পত্র না থাকায় এক এক সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় দিয়ে অপর্কম চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ক্ষুণ্ন হয়ে চলেছে কক্সবাজারের সুনাম। প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের উন্নয়ন। এসব দূরীকরণে সরকার কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর অংশ হিসেবে গত ২৭ নভেম্বর টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম এমপি। এছাড়া বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাসহ সব অবৈধ বিদেশির তালিকা করছে সরকার। মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, রোহিঙ্গা এখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে, এরা মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবিক বিষয়গুলো দেখভাল করতে হবে। তাদের সার্বিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হচ্ছে। এ জন্যে নৈসর্গিক সৌন্দয্যের লীলা নিকেতন এ কক্সবাজারের উন্নয়ন ও পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে এখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুবিধাজনক অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা কী আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, দু দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করছে। যথাসম্ভব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। মানবপাচার, মাদক ব্যবসাসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা রোহিঙ্গারা করতে পারে না। শুধু নিবন্ধিত নয়, অনিবন্ধিতদের ব্যাপারেও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান এমপি বদি।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা সাজেদা বেগম জানান, মিয়ানমারে আমাদের নাগরিকত্ব প্রদান করার ব্যবস্থা করা হোক অথবা ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হোক। আর না হয় এখন যেখানে আসি সেখানেই ভালো আছি।

ক্যাম্পের বি ব্লকের বাসিন্দা ডা. ইব্রাহীম জানান, আমরা দেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত আছি যদি মিয়ানমার অন্যান্য নাগরিকের মতো আমাদের অধিকার দেয়। না হয় আমাদের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব দেয়া হোক না হয়। আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও সরে যাবো না।

শরণার্থী, ত্রাণ ও পুর্নবাসন কমিশনার মো. ফিরোজ সালাহউদ্দীন জানান,‘গত চার-পাঁচ বছরে, বিভিন্ন সময়ে ৯০২ জনকে কানাডা, নরওয়ে, সুইডেন, ইত্যাদি দেশে পুনর্বাসিত করা হয়েছে, তবে এ প্রক্রিয়া এখন বন্ধ আছে। এ বিষয়ে ইউ.এন.এইচ.সি.আর-কে একটি সার্বিক পরিকল্পনা দিতে বলা হয়েছে।‘, জানিয়েছেন সালাহউদ্দীন।

এই ৯০২ জন যাবার পর, এই প্রক্রিয়া একেবারে থেমে আছে। তবে এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন স্থানীয়রা। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন উন্নত দেশগুলো তাদের দায়িত্ব দায়সারাভাবে পালন করছে। ৩৩ হাজার শরণার্থীর মধ্যে শুধু ৯০০ জনকে গত পাঁচ বছরে নিয়ে যাওয়ায় কোনো লাভ হয়নি। কারণ প্রতি বছর এই দুই ক্যাম্পে এক বছরে যত শিশু জন্ম নেয় তা ৯০০ থেকে অনেক বেশি। ‘বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে যে, এই মানুষগুলোর পশ্চিমা দেশে চলে যাওয়ার খবর যখন মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় যাচ্ছে, তখন আরো বেশিসংখ্যক মানুষ আবার এদিকে চলে আসছে।

গত বৃহস্পতিবার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে এসে মজীনা শরণার্থীদের বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টকে একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আন্তর্জাতিকভাবেও রকমের চাপ দেয়া হচ্ছে। এর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটা বড় ভূমিকা আছে। পাশাপাশি যে শরণার্থীদের অধিকার অনুযায়ী তাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবার কথা, তা সাধ্যমত দেয়ার চেষ্টা যেন করে বাংলাদেশ সরকার।

সূত্র: নতুনবার্তা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন