শরণার্থি ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাকে পুনর্বাসিত করতে চাইছে টাস্কফোর্স
সরকারি অর্থায়নে পুনর্বাসনের আওতায় আসছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলার ৮২ হাজার উদ্বাস্তু পরিবার। এ জন্য এ তিন পার্বত্য জেলার ৮১ হাজার ৭৭৭ উদ্বাস্তু পরিবারের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর নগরের সার্কিট হাউসে আয়োজিত ‘ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন’ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এর ৯ম সভায় এ তালিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন টাস্কফোর্সের সভাপতি ও সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি।
সভায় পুনর্বাসনের জন্য ভারত থেকে প্রত্যাগত ২১ হাজার ৯০০ শরণার্থী পরিবারের তালিকাও অনুমোদন দিয়েছে টাস্কফোর্স। এছাড়াও উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের ঋণ মওকুফ, ফৌজদারী মামলা প্রত্যাহার, প্রত্যাগত শরণার্থীদের চাকরিতে জ্যেষ্ঠতা প্রদান, রেশন দেওয়া এবং টাস্কফোর্স সদস্যদের সম্মানি ভাতা নিয়ে আলোচনা করেন টাস্কফোর্স সদস্যরা।
ঋণ মওকুফের বিষয়ে টাস্কফোর্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা সভায় জানান, উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের ঋণ মওকুফ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে ঋণদাতা সোনালি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক এবং বিআরডিবির ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি অগ্রগতির পর্যায়ে রয়েছে।
উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ৪৫১টি ফৌজদারী মামলা রয়েছে বলে সভায় জানান, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, এসব মামলার মধ্যে ৪৪৬টি মামলা ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকি মামলাগুলোতে কিছু জটিলতা থাকলেও তা নিরসন করে দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে।সূত্র: বাংলানিউজ২৪.কম, তারিখ: ২৫-০৯-২০১৮।
এদিকে এই সভার পরপরই তিন পার্বত্য জেলার বাঙালি সংগঠনগুলো টাস্কফোর্সের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। ঢাকায় ও তিন পার্বত্য জেলায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান করেছে। সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বাঙালী সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের কারণ দুইটি। এক. ভারত প্রত্যাগত ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু শরণার্থিদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তি। দুই. পুনর্বাসনের তালিকা থেকে অউপজাতীয় বা বাঙালী উদ্বাস্তুদের তালিকা বাদ দেয়া।
বাঙালী সংগঠনগুলো দাবী করছে, নতুন করে বিপুল সংখ্যক ভারত প্রত্যাগত ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর নামে ভারতীয় ও মিয়ানমারের নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে নিরাপত্তার অজুহাতে গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসন করা ২৬ হাজার বাঙালী পরিবারকে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তাদের কবুলিয়ত প্রাপ্ত জমিতে পুনর্বাসন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে নানাভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এই নতুন সঙ্কটের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য অনুসন্ধান শুরু করি।
ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স
শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ১ ধারায় বলা হয়েছে,
১) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত উপজাতীয় শরণার্থীদের দেশে ফিরাইয়া আনার লক্ষ্যে সরকার ও উপজাতীয় শরণার্থী নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ৯ মার্চ ’৯৭ ইং তারিখে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২৮ মার্চ ’৯৭ ইং হইতে উপজাতীয় শরণার্থীগণ দেশে প্রত্যাবর্তন শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকিবে এবং এই লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির পক্ষ হইতে সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতা প্রদান করা হইবে। তিন পার্বত্য জেলার আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের নির্দিষ্টকরণ করিয়া একটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
২) সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতঃ উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চুড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভূক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন। শান্তিচুক্তির এই ধারা ‘ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন’ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এর মূল উৎস।
শান্তিচুক্তির পর প্রথম টাস্কফোর্স গঠিত হয় ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি। প্রথম কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন রাঙামাটিতে থেকে নির্বাচিত তৎকালীন এমপি দীপঙ্কর তালুকদার। সেই কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন:
- বীর বাহাদুর- এমপি
- প্রতিনিধি- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়
- প্রতিনিধি- খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ
- প্রতিনিধি- রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ
- প্রতিনিধি- জিওসি, ২৪ পদাতিক ডিভিশন, সেনাবাহিনী
- প্রতিনিধি- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি
- প্রতিনিধি- প্রত্যাগত শরণার্থি কল্যাণ সমিতি।
- সদস্য সচিব- চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। ২০ আগস্ট ২০০১ সাল পর্যন্ত এই টাস্কফোর্সের মেয়াদ ছিলো।
চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় কমিটি গঠিত হয় ২০০৩ সালের ২৯ অক্টোবর। দ্বিতীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পান সমীরণ দেওয়ান। এই টাস্কফোর্সে বান্দরবান জেলা পরিষদের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। জেএসএসের পক্ষ থেকে সুধাসিন্ধু খীসা এবং প্রত্যাগত শরণার্থি কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে এর সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা(বকুল) অন্তর্ভূক্ত হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় কমিটিতে জাফর আহমদ নামে একজন পার্বত্য বাঙালী প্রতিনিধিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সেই থেকে টাস্কফোর্সে বাঙালি প্রতিনিধি প্রতিনিধিত্ব করছে।
বর্তমান টাস্কফোর্সে বাঙালি প্রতিনিধি রয়েছেন, খাগড়াছড়ির আওয়ামী লীগ নেতা এসএম সফি। তবে অসুস্থ থাকায় বর্তমানে তিনি নিষ্ক্রিয়। ২০০৯ সালের ২৩ মার্চ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপিকে টাস্কফোর্সের নতুন চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয় এবং ২৭ আগস্ট পূর্ণাঙ্গরূপে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়। ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসাবে যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরাকে সরিয়ে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি দায়িত্ব দেয়া হয়। এখনো তিনিই দায়িত্ব পালন করছেন। এই পদটি প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার।
ভারত প্রত্যাগত শরণার্থি কি?
স্বাধীনতার পর ’৭০ এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইনসার্জেন্সি শুরু হওয়ার পর এবং শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বা ভীতগ্রস্ত হয়ে যেসকল উপজাতি পরিবার বা সদস্য নিজ বসত ভিটা ত্যাগ করে ভারতে গমন করেছিল এবং শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত থেকে ফিরে এসেছে তারা ভারত প্রত্যাগত শরণার্থি।
শান্তিচুক্তির পূর্ববর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবল উত্তাল দিনগুলোতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ব্রিগ্রেড কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বপালনকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল(অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহীম তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তিপ্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ পুস্তকে লিখেছেন, ‘ প্রতিষ্ঠিত সরকারকে নিজেদের দাবী মানতে বাধ্য করতে চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ইনসার্জেন্টদের গৃহীত অন্যতম কৌশল হচ্ছে, নিজেদের সমস্যার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আর আন্তর্জাতিকীকরণের অন্যতম উপায় হচ্ছে, নিজেদের সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকহারে উদ্বাস্তু করে শরণার্থি হিসাবে সহানুভূতিশীল কোনো দেশে আশ্রয় গ্রহণ করানো।
শান্তিবাহিনীও একই কৌশলে তাদের সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে বিদেশের মাটিতে উপজাতীয় শরণার্থি নামক একটি সমস্যার সৃষ্টি করে। শান্তিবাহিনী উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাঙালীদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের উত্তেজিত করে উপজাতীয়দের উপরে প্রতিশোধ গ্রহণে বাধ্য করে। এতে উপজাতীয়রা আতঙ্কে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থি হিসাবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়। কখনো কখনো শান্তিবাহিনী অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক উপজাতীয়দের শরণার্থি হতে বাধ্য করে। তবে এই প্রক্রিয়ায় সহানুভূতিশীল দেশের সবুজ সঙ্কেত অবশ্যই প্রয়োজন।’ (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা- ১৫৯ দ্রষ্টব্য)।
অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু
স্বাধীনতার পর ’৭০ এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইনসার্জেন্সি শুরু হওয়ার পর এবং শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বা ভীতগ্রস্ত হয়ে যেসকল উপজাতি পরিবার বা সদস্য নিজ বসতভিটা ত্যাগ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছিলেন তারা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে দীপঙ্কর তালুকদারের নেতৃত্বাধীন প্রথম টাস্কফোর্সের তৃতীয় বৈঠক অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা চুড়ান্ত করা হয় সর্বসম্মতিক্রমে।
এই টাস্কফোর্সের প্রণীত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা হলো: ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৯২ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত যে সকল উপজাতীয় ও বাঙালী নিজ গ্রাম, মৌজা ও অত্র অঞ্চল ত্যাগ করিয়া দেশের মধ্যে অন্যত্র চলিয়া যায় বা চলিয়া যাইতে বাধ্য হয়, তাহারাই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু।’ ইত্তেফাক: ২৯-১১-২০০০ দ্রষ্টব্য।
২২ নভেম্বর ২০০০ সালে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২ বছরের বেশীকাল স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে শুমারী শেষে মোট ১ লাখ ২৮ হাজার ৩১৪ পরিবারকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসাবে চুড়ান্ত তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৯০ হাজার ২০৮টি উপজাতীয় পরিবার, ৩৮ হাজার ১৫৬টি অউপজাতীয় বা বাঙালী পরিবার রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ বাঙালী উদ্বাস্তু
শান্তিচুক্তির পূর্বে যুদ্ধকালীন অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩০টি গ্রাম থেকে ২৬ হাজার বাঙালী পরিবারকে সরকার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে নিজ বসত ভিটা সরিয়ে নিয়ে ৬৮টি গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়াও গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টির আগে ও পরে অনেক বাঙালী সংঘর্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বা আতঙ্কিত হয়ে নিজ বসত ভিটা ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বাংলাদেশের অন্যস্থানে পুনর্বাসিত হয়েছে। প্রথম টাস্কফোর্স কমিটির সংজ্ঞা ও বাস্তবতার বিবেচনায় এই বাঙালীরাও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু।
তবে শুরু থেকেই জেএসএস নেতা সন্তু লারমা টাস্কফোর্সের আওতায় অভ্যন্তরীণ বাঙালী উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিরোধিতা করতে থাকে। কিন্তু টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান দীপঙ্কর তালুকদার এর প্রতিবাদে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদের অস্তিত্বের কথা সমিতি চুক্তিতেই স্বীকার করিয়া নিয়াছে। আঞ্চলিক পরিষদের এক তৃতীয়াংশ সদস্যই হইল বাঙালী। অতএব এক তৃতীয়াংশ বাঙালীতো উদ্বাস্তু হইতেই পারে।’ ইত্তেফাক: ২৯-১১-২০০০ দ্রষ্টব্য। তবে শন্তিচুক্তিতে ‘আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের’ কথায় বলা হয়েছে কেবলমাত্র।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তিতে সরকার ঘোষণা করেছে, শান্তিবাহিনীর যেসকল সদস্য অস্ত্র সমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে তাদেরকে সরকার বিভিন্নভাবে সুবিধা দিয়ে পুনর্বাসন করবে। সেমতে, সরকার অস্ত্র সমর্পণকারীদের পুনর্বাসন করেছে। শান্তিচুক্তির এ ধারা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার পূর্বে বা শান্তিচুক্তি পরবর্তীকালে অস্ত্র সমর্পন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পর, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত কেউ অস্ত্র সমর্পন করে বা শরণার্থিদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন শেষ হওয়ার ভারত থেকে ফিরে আসে- তিনিও কি একই সুবিধা পাবেন?
শান্তিচুক্তি পরবর্তীকালে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া, অস্ত্র সমর্পন করা বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কোনো উপজাতীয় সন্ত্রাসীকে বাংলাদেশ সরকার প্রতিশ্রুত ২০ দফা পুনর্বাসন প্যাকেজ সুবিধা দেয়নি। সেই বিবেচনা থেকে বলা যায়, পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই ড্যামের কারণে ও মুক্তিযুদ্ধকালে এবং শান্তিচুক্তি পরবর্তীকালে নানা কারণে যেসকল উপজাতীয় পরিবার ভারতে চলে গিয়েছেন অথবা অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন বা হতে বাধ্য হয়েছেন, তারা শান্তিচুক্তিতে উল্লিখিত ভারত প্রত্যাগত শরণার্থির আওতায় পড়ে না। যদি এমন কেউ থেকে থাকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা ব্যাপারে রাষ্ট্রের অপর সিদ্ধান্ত থাকা উচিত।
একইভাবে ‘পার্বত্য চুক্তির আওতাভূক্ত প্রত্যাবাসিত শরণার্থি’ বলতে সরকার ও উপজাতীয় শরণার্থী নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ৯ মার্চ ’৯৭ ইং তারিখে চুক্তি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে যে শরণার্থিদের উল্লেখ করা হয়েছে তাদের পুনর্বাসনই কেবল এই টাস্কফোর্সের বিবেচ্য। এই তালিকার বাইরে যেসকল শরণার্থি যেকোনোভাবে বাংলাদেশে এসে থাকেন তারা যদি প্রকৃতই বাংলাদেশী শরণার্থি হয়ে থাকেন তবে তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশের দায়িত্ব। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই আগরতলায় করতঃ ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির আওতায় নয় এবং টাস্কফোর্সের বিবেচ্য নয়।
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পুণর্গঠিত টাস্কফোর্সের চতুর্থ সভায় এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত আসে। এতে বলা হয়, ‘পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে প্রত্যাগত উপজাতীয়দেরকে পার্বত্য চুক্তির আওতায় স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনকারী হিসাবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই বিধায় তারা টাস্কফোর্সের আওতাভূক্ত নয়। সুতরাং তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই’।
একই মত প্রকাশ করা হয়েছে, টাস্কফোর্সের ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম সভায়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের কার্যবিবরণী পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘টাস্কফোর্সের কার্যপরিধির আওতায় প্রত্যাগত শরণার্থিদের মধ্যে যারা পার্বত্য চুক্তির আওতাভূক্ত পূনর্বাসনের ক্ষেত্রে কেবল তারাই বিবেচনার যোগ্য হবেন। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে প্রত্যাগত শরণার্থিদের মানবিক বিবেচনায় তাদেরকে অন্য কোনোভাবে পুনর্বাসিত করা যেতে পারে।’ টাস্কফোর্সের এই মত নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই এবং বাংলাদেশ সরকারও শান্তিচুক্তির পূর্বে স্বেচ্ছায় ও আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন সময় আগত প্রত্যাগত শরণার্থিদের মানবিক বিবেচনায় ১৬ দফা ও ১৯ দফা প্যাকেজের আওতায় পুনর্বাসন করেছে- যার কিছু তথ্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
চলবে…
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা
- ♦ বিশ্ব আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা কাম্য
- ♦ বিতর্কিত সিএইচটি কমিশনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে
- ♦ আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে
- ♦ একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী
- ♦ বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক
- ♦ আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩
- ♦ শান্তিচুক্তির এক যুগ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ গোষ্ঠির অতিআগ্রহ বন্ধ করতে হবে
- ♦ হঠাৎ উত্তপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম: খতিয়ে দেখতে হবে এখনই
- ♦ অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান সময়ের দাবী
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কি কাজ
- ♦ রোহিঙ্গা ইস্যু : শেখ হাসিনা কি ইন্দিরা গান্ধী হতে পারেন না?
- ♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক নীতি-কৌশলের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন
- ♦ পাহাড়ের উৎসব: ‘বৈসাবি’ থেকে হোক ‘বৈসাবিন’
- ♦ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন: সরকারের মর্যাদা কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হতে পারে
- ♦ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন বৈষম্যমূলক ও বাঙালি বিদ্বেষী
- ♦ ভারত ভাগের ৬৯ বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন দিবস পালন করে পাহাড়ী একটি গ্রুপ
- ♦ বিজিবি ভারতের ভূমি ও সড়ক ব্যবহার করে বিওপি নির্মাণ করছে
- ♦ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করতে তথ্য বিবরণী জারী করেছে সরকার
- ♦ বিজিবি’র মর্টার গোলার আঘাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ২ কর্মকর্তাসহ ৪ সেনাসদস্য নিহত: আহত ৩
- ♦ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলিতে আরো ৪ বিজিবি সদস্য নিখোঁজ (ভিডিওসহ)
- ♦ নাইক্ষ্যংছড়ির বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে চরম উত্তেজনা : মিয়ানমারের বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন, গুলিবর্ষণ
- ♦ জেএসএস’র খাগড়াছড়ির পুনরুদ্ধার মিশন: দ্রুত অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম
- বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করতে তথ্য বিবরণী জারী করেছে সরকার
- বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয় কেন?