লামায় বৌদ্ধ বিহারের মূর্তি ভাঙ্গার অভিযোগে মামলা: ঘটনা জানেন না স্থানীয়রা

লামা প্রতিনিধি:

লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লুলাইং মুরুং পাড়ার ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহারের ৩০টি মাটির তৈরি ছোট ছোট বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুরের অভিযোগ এনে লামা বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিগণ জানিয়েছেন, বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙ্গার কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে লুলাইং এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ভূমি বিরোধ চলে আসছে এবং বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে অনেকে আত্মগোপন করে আছে।

৩০৪নং লেমু পালং মৌজার মেনইয়াং মুরুং এর ছেলে আমেন মুরুং (৩৭) বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত লামায় ফৌজদারী অভিযোগ এনে দাবি করেছেন, সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মকবুল আহমদ(৬৫), সাবেক উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সেতারা আহমদ (৫০) ও শহর মল্লুকসহ আরও ১০/১২ জন বৌদ্ধ বিহারের ভোগদখলীয় জায়গা জবর দখলের চেষ্টা করে আসছে। গত ৩১ আগস্ট রাত ১০টায় বর্ণিত ব্যক্তিগণ বৌদ্ধ বিহারের জায়গা জবর দখল করার জন্য অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জন গিয়ে বিহারের জায়গায় রোপিত গাছপালা নষ্ট করে। সে সময় তারা ৩০টি মাটির তৈরি ছোট ছোট বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুর ও বৌদ্ধ বিহারের ৬০ হাজার টাকা মূল্যের সম্পদের ক্ষতিসাধন করে মর্মে ফৌজদারী অভিযোগে আমেন মুরুং দাবি করেছেন। বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দায়ের করার জন্য লামা থানার অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলায় অভিযুক্ত মকবুল আহমদ জানান, লামা উপজেলার লেমু পালং, লুলাইং মৌজায় তাঁর ও তাঁর স্ত্রী সেতারা আহমদের নামে খরিদাসূত্রে জায়গা সম্পত্তি আছে। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং কিছু বিশেষ মহল তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মুরুং অধিবাসীদের ব্যবহার করে উপজাতি-বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লেমুপালং মৌজায় হোল্ডিং নং- ০১,৫৭,৩৫,৬৭ ও ৬৬নং হোল্ডিং এ প্রায় ২২ একর জায়গা খরিদাসূত্রে মালিকানায় রয়েছে। লুলাইং ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহার স্থাপনের জন্য মকবুল আহমদ জায়গা দান করেছেন বলে জানিয়েছেন।

লামা থানার রেকর্ড পর্যালোচনায় জানা গেছে, লুলাইং এলাকায় একটি পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। খুন, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজীসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর জন্য নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে লুলাইং এলাকা ব্যবহার হয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাড়া খেয়ে সন্ত্রাসীরা আত্মগোপন করে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চলে গেলে পুনরায় এলাকায় সন্ত্রাসীরা গমন করে। এভাবে লুলাইং ও লেমুপালং এলাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণকারী গড ফাদার ধন বিকাশ চাকমা প্রকাশ উমাং চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী মামলায় বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছে। লুলাইং এলাকার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ব্যাপারে বান্দরবান সদর থানায় মামলা নং- ১৬ তারিখ: ১৮/০৮/২০১৬, মামলা নং- ৪, তারিখ: ০৯/০৫/২০১৫, লামা থানার মামলা নং- ০৬ তারিখ: ০৭/০৪/২০১৭ সহ আরও অসংখ্য মামলা রয়েছে। ১০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করায় ধন বিকাশ চাকমাসহ ১০ জনের নামে লামা থানায় মামলা চলমান। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়েরকৃত চাঁদাবাজীর আরো একটি মামলা লামা থানায় রেকর্ড করা হয়েছে। লুলাইং এলাকা প্রায় ২০ জনের অধিক ব্যক্তির নামে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

লুলাইং মৌজার হেডম্যান মি. সিংপাস চৌধুরী জানান, গত ২ বছরের অধিক সময় ধরে লুলাইং মুরুং পাড়ার ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহারে কোন বৌদ্ধ ভিক্ষু নাই। বৌদ্ধ বিহারের কিছু বৌদ্ধ মূর্তি পাশ্ববর্তী বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

সরই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলী সিকদার জানান, লুলাইং ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহার ২০০৩ সনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক সহায়তায় এই বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ফরিদুল আলম জানান, লুলাইং বৌদ্ধ বিহারের জায়গা নিয়ে বিরোধ আছে। তবে বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙ্গার কোন ঘটনা তিনি শোনেন নাই। চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম আরও জানান, বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙ্গা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ জাতীয় কোন ঘটনা ঘটলে তিনি জানতেন। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি তাকে জানাতেন।

ক্যজু পাড়া পুলিশ ফাঁড়ির আইসি উপ-পরিদর্শক আবুল কাশেম জানান, লুলাইং এলাকায় কোন বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুরের কোন ঘটনা ঘটে নাই। বিশেষ মহল এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য এ জাতীয় কাল্পনিক অভিযোগ এনেছেন। লুলাইং ও লেমুপালং এলাকার সকল বৌদ্ধ বিহারে পুলিশ ফাঁড়ির মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। বৌদ্ধ বিহার কমিটি বা স্থানীয় জনসাধারণ এ জাতীয় কোনো ঘটনা পুলিশ ফাঁড়িতে জানায়নি। তছাড়া পুলিশের নিয়মিত টহল রয়েছে। গজালিয়া পুলিশ ফাঁড়ির আইসি পরিদর্শক বেলাল হোসেন সিকদার জানান, আমি লুলাইং এলাকা পরিদর্শন করেছি। এরকম কোন ঘটনা কেউ আমাকে বলেনি। এলাকায় যাওয়ার পরও কেউ জানায়নি। মূর্তি ভাংচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

লামা থানার অফিসার ইনচার্জ অপ্পেলা রাজু নাহা জানান, লুলাইং ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহারের মূর্তি ভাংচুরের কোনো সংবাদ বা কোনো তথ্য কেউ জানায়নি। এরকম একটি স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটে থাকলে অব্যশই জানতাম। বৌদ্ধ বিহার কমিটি বা এলাকার কোনো লোক এ জাতীয় ঘটনা জানায়নি। স্থানীয় লোকজনও এরকম কোনো ঘটনা জানে না। এ জাতীয় মামলার পিছনে কোনো রহস্য থাকতে পারে। আদালতের অভিযোগটি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা হচ্ছে।

লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি জানান, লুলাইং ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুরের কোনো ঘটনা আমাদের জানা নেই। অফিসার ইনচার্জও এরকম ঘটনা জানে না। এরকম কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে কেউ না কেউ জানাতো। তবে লুলাইং এলাকার ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ আমার দপ্তরে আছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন