লবণশিল্পকে সিন্ডিকেটের কবলমুক্ত করার দাবি চাষিদের

মহেশখালী প্রতিনিধি:

এদেশের চাষিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করছেন সাদা সোনা খ্যাত লবণ। তবে লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুমে মহেশখালী উপজেলাসহ উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার লবণ চাষি জিম্মি হয়ে পড়েছে মধ্যসত্ত্বভোগি মহাজন ও দালাল চক্রের হাতে। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে মধ্যসত্ত্বভোগিদের কাছে লবণ চাষিদের অবস্থান অনেকটা দাসের মতোই। কোনভাবেই ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না হতভাগা এসব লবণ চাষির। লবণ চাষিদের আর্থিক অবস্থা কয়েক যুগ আগেও যেমন ছিল, বর্তমানে তাই।

প্রতি মওসুমে হত দরিদ্র এসব লবণ চাষির হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফল (লাভ) যাচ্ছে মধ্যসতত্ত্বভোগী সিন্ডিকেট দালাল চক্রের পকেটে। এমনকি গত মওসুমের শেষের দিকে সরকার প্রতি কেজি লবণের মূল্য ৪ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়ায় দামের বিন্দু মাত্রও প্রভাব পড়েনি মাঠ পর্যায়ে।
শুধু তাই নয়, সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরও দেখা পায়নি লবণ চাষিরা। ফলে লবণ উৎপাদনে মহেশখালীসহ উপকূলীয় লবণ উৎপাদনকারী উপজেলার লক্ষাধিক লবণ চাষি চরম হতাশা ভুগছে।

লবণ চাষিদের দাবি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে লবণ কিনে নায্যমূল্য নিশ্চিত করা হোক। তবে তা যেন লবণ বোর্ড গঠন করে করা হয়। চাষিদের অভিযোগ লবণের দর নিয়ন্ত্রণ মিল মালিকদের হাতে থাকার কারণে চাষিরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করেও চাষিরা তাদের নায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। লবণ মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয়। এরপরও বেশি মুনাফার আশায় আমদানির চক্রান্ত করে চিহ্নিত সিন্ডিকেট। তাদের সুযোগ দিলে চলবে না। ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন একটি পরিবারে কী পরিমাণ লবণ প্রয়োজন? চাহিদার সাথে উৎপাদনের সমতা থাকলে কোন যুক্তিতে লবণ আমদানি করবে?

তারা বলেন, সিন্ডিকেটকে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা হোক। উৎপাদন মওসুমে লবণ আমদানি চাই না। দেশীয় লবণশিল্প বাঁচাতে সরকারের একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। এ বিষয়ে বিসিককে আন্তরিক হতে হবে।

গত কয়েকদিন ধরে সরজমিন মহেশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকার লবণ চাষি ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। মহেশখালী উপজেলা কালারমারছড়া ইউনিয়নের উত্তরনলবিলা এলাকার লবণ চাষি মো. ভুট্টো (৩৬) দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে লবণ চাষে নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। প্রায় ৫ একর লবণ চাষের জমি রয়েছে তার।

ভূট্টো বলেন, পৈত্রিক পেশা ধরে রাখতে লবণ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠি। মনে করছিলাম একসময় পরিবারেও আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হওয়ার কোন কোন লক্ষণ দেখছি না। শুধু দেখছি, তিলে তিলে লবণ চাষিদের সর্বনাশ হতে।

তিনি বলেন, ‘যে সব যে সব লবণ মাঠ মধ্যস্বত্ত্বভোগিরা আগে জমিদারের কাছ থেকে লাগিয়ত নিয়ে কিছু টাকা বিনিয়োগ করে লবণ চাষের জন্য চাষিদের মাঠে নামায়, তাদের ক্ষেত্রে এ নিয়মে উৎপাদিত লবণের বিক্রয় মূল্যের অর্ধেক দেওয়া হয়। এমনকি ৪০ সেরে ১ মণ হলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণ মাঠ থেকে সংগ্রহ করে ৬০ কেজিতে মণ হিসেবে।’

ভূট্টোসহ অসংখ্য লবণ চাষি বলেন, উপজেলার হোয়ানক ও কালারমারছড়ার উত্তরনলবিলা-চালিয়াতলী এলাকার আলোচিত কয়েকজন মধ্যস্বত্ত্বভোগী মহাজন ও দালালের কিভাবে ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে তা না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না। এদের অনেকেই অল্প সময়ের মধ্যে কোটিপতিও বনে গেছেন। মালিক হয়েছেন বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়িসহ অট্টালিকার। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে লবণ চাষিদের পরিশ্রমের ফসল। উত্তরনলবিলা-চালিয়াতলী প্রভাবশালী দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোউ মুখ খুলে না। একইভাবে উপকূলীয় এলাকার বেশিরভাগ লবণ মাঠ মধ্যস্বত্ত্বভোগী মহাজনদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রতি বছর জমি মালিকদের কাছ থেকে মধ্যস্বত্ত্বভোগী এসব জমি আগাম লাগিয়ত নিয়ে তাদের দেনা গ্রস্থ লবণ চাষিদের দাসের মতই ব্যবহার করে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় সাধারণ লবণ চাষিরা কোনরকম অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে রয়েছেন। চাষিরা জানান, প্যাকেটজাত লবণ উৎপাদকারী অসাধু মিল মালিকদের সাথে মধ্যস্বত্ত্বভোগী সিন্ডিকেটের যোগসাজস থাকায় সরকার নির্ধারিত দামও পাচ্ছে না। তাই এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে লবণ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান চাষিরা। তা না হলে আগামীতে লবণ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। যা এ শিল্পের জন্য চরম অশনি সঙ্কেত। উপজেলার হোয়ানক এলাকার লবণ চাষি আববাস (৩৩) আক্ষেপ করে বলেন, দেশের মানুষের খাদ্য তালিকার অন্যতম উপকরণ লবণ উৎপাদন করছি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। কিন্তু বরাবরের মতোই উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা।

জানা গেছে, পৈত্রিক পেশা হিসেবে লবণ চাষিরা জীব-জীবিকার তাগিদে এ পেশায় এখনও টিকে রয়েছে। প্রতিবছর তপ্তরোধে মাঠে শ্রম দিয়ে গাছের গুটি (গরান) ঠেলে লবণ উৎপাদন করলেও লবণ বিক্রির সিংহভাগ লাভ চলে যায় মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও মহাজনদের গোলায়।

সূত্র মতে, উৎপাদিত লবণের বিক্রয়লব্ধ অর্থের সিংগভাগই হাতিয়ে নেয় ওইসব মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও দালাল চক্র। চলতি মৌসুমে প্রতিমণ লবণ ২৭০-২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রিত লবণ মূল্যের প্রতি মণ থেকে ৫০-৬০ টাকা যায় দালালদের পকেটে। কয়ালীর (পরিমাপকারী) পকেটে যায় প্রতি মণে ৫ টাকা, গুদী টেক্স হিসেবে ১ টাকা এবং লেবার খরচ ১৫-২০ টাকা। এ পরিমাপ টাকা বাদ যাওয়ার পর অর্ধেক টাকা পায় লবণ চাষিরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার আঞ্চলিক বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী বলেন, চলতি মৌসুমে ১৩টি কেন্দ্রের (মোকাম) অধীনে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা (আংশিক) সহ ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। তার মধ্যে মহেশখালী উপজেলার নোনাছড়ি মোকামে ৬ হাজার ৬১৮ একর, উত্তর নলবিলা মোকামে ৬ হাজার ৫২৮ একর, গোরকঘাটা মোকামে ৩ হাজার ৮৭৭ একর, মাতারবাড়ি মোকামে ৫ হাজার ৫৮ একর ও মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে স্থাপিত লবন প্রর্দশনী কেন্দ্রে ৯৪.২৬ একর।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বীকার করে বলেন, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারণে চাষিদের শোষন-বঞ্চনা শেষ হচ্ছে না। চাষিদের লাভের বড় অংশ চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে।

মহেশখালী-কুতুবদিয়ার এমপি আলহাজ্ব আশেক উল্লাহ রফিক অতিরিক্ত মুনাফা বন্ধে সরকারকে কঠোর নজরদারি বাড়ানোর দাবি তুলে বলেন, প্রান্তিক চাষি থেকে কম দামে লবণ কিনে অধিক দামে বিক্রি করার মানসিকতা থেকে লবণের সমস্যা। সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। লবণ নিয়ে ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। প্রান্তিক চাষিদের পরিশ্রমের মূল্য দিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন