লংগদুবাসীর ইশতেহার

সৈয়দ ইবনে রহমত::
সাধারণত কোনো দল, জোট কিংবা ব্যক্তি নির্বাচনের পূর্বে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে যেসব প্রতিশ্রুতি দেন সেটাই তার বা তাদের ইশতেহার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিভিন্ন দল এবং জোটের পক্ষ থেকেও প্রতিনিয়ত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই স্বাভাবিক। কেননা ভোটাররা কোন দল বা জোটকে ভোট দেবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জোট, দল বা নেতার পক্ষ থেকে যেমন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার থাকে, তেমনি ভোটারদের পক্ষ থেকেও নানা দাবি থাকে বা থাকতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ নং আসন রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগদুবাসীর পক্ষ থেকেও পাঁচটি দাবি রয়েছে। দাবিগুলো হচ্ছে গুলশাখালী উপজেলা গঠন, লংগদু পৌরসভা গঠন, কাপ্তাই লেকের উপর সংযোগ সেতু নির্মাণ, থেগামুখ থেকে মাইনীমুখ সড়ক নির্মাণ এবং বাঘাইছড়ি থেকে ভাসান্যাদম সড়ক নির্মাণ। ইতোমধ্যে লেকের পূর্বপাড়ের ইউনিয়নগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ দ্রুত শেষ করার পাশাপাশি উল্লেখিত পাঁচটি দাবি বাস্তবায়ন করা হলে লংগদুবাসীর ভাগ্য পরিবর্তন যেমন সহজ হবে, তেমনি এখান থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। আর এসব দাবি বাস্তবায়নে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি দাবি আদায়ের প্রতি স্থানীয় জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা, সচেতনতা ও দৃঢ়চেতা মনোভাব একান্তভাবে প্রয়োজন। কারণ, চাইতে না জানলে কেউ আপনা থেকে কিছু দিয়ে যাবে না।

গুলশাখালী উপজেলা: স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উঠেছে; লংগদু উপজেলাধীন ভাসান্যাদম, বগাচতর, গুলশাখালী এবং বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন আমতলী ইউনিয়নকে নিয়ে একটি উপজেলা গঠন করার জন্য। বিষয়টি নিয়ে মিছিল-মিটিং করাসহ সামাজিক গণমাধ্যমে মতামত ব্যাক্ত করে দ্রুত উপজেলা বাস্তবায়নের দাবি তুলছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা। ইতোমধ্যে স্থানীয় এবং জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও ব্যাপক লেখালেখি চলছে উপজেলার দাবিতে। উল্লেখিত চারটি ইউনিয়নের মোট আয়তন ২৮৯.১৪৫ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক থেকে দেশের অনেক উপজেলার চেয়ে এখানে একটি নতুন উপজেলা গঠন করা অত্যন্ত যৌক্তিক। তাছাড়া, কাপ্তাই লেক দ্বারা উপজেলা সদর থেকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্থানীয় জনগণকে সরকারি সেবা পেতে আট থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় এলাকাটি আশানুরূপ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত, নেই তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং প্রশাসনিক সেবা পেতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়। বছরে পাঁচ মাস লেকে পানি থাকে, এসময় যোগাযোগ কিছুটা সহজ হলেও অবশিষ্ট সাত মাস দুর্ভোগের শেষ থাকে না। তাছাড়া এ চারটি ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ। ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় এখানে উপজেলা গঠন করা স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকার। তাদের এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি।

লংগদু পৌরসভা: পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত প্রথম কয়েকটি থানার একটি লংগদু। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রাচীনত্বের তুলনায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন লংগদুবাসীর কপালে জোটেনি। লংগদু সদর থেকে স্থানীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র মাইনীমুখ বাজারের সাথে সড়ক যোগাযোগ নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি। রাস্তাটি দিয়ে মোটরসাইকেল এবং মাহেন্দ্র গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচলও করতে পারে না। কারণ, রাস্তাটির বেশ কিছু অংশ এখনো কাঁচা এবং অপ্রশস্ত। কোনো কোনো স্থানে তো বর্ষায় মোটরসাইকেলেও চলাচল করা বিপদজনক হয়ে উঠে। স্থানীয় অর্থনীতির লাইফ লাইন এই সড়কটি দ্রুত প্রশস্ত করে পিচ ঢালাইয়ের ব্যবস্থা করে বাস-ট্রাক চলার উপযোগী করার জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। তাছাড়া এই সড়কটিকে ভিত্তি ধরে মাইনীমুখ বাজার, মুসলিমব্লক, বাইট্টাপাড়া এবং লংগদু সদর নিয়ে লংগদু পৌরসভা গঠন করা যায়। এখানে পৌরসভা হলে স্থানীয় জনগণের জীবন-মান যেমন উন্নত হবে, চাঙ্গা হবে স্থানীয় অর্থনীতি, তেমনি বাড়বে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও। বিষয়টি নেতৃবৃন্দের বিবেচনায় নেয়ার দাবি রাখে।

লেকের উপর সংযোগ সেতু: লংগদু উপজেলাধীন ভাসান্যাদম, বগাচতর, গুলশাখালী এবং বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন আমতলী ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কাপ্তাই লেক। অথচ মাত্র একটি ব্রিজই পারে লেকের দুই তীরের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে দিতে। ইতোমধ্যে মাইনীমুখ বাজারের সাথে উত্তর গাঁথাছড়াকে সংযুক্ত করার জন্য একটি ব্রিজ নির্মাণাধীন আছে। কিন্তু এর সুফল গাঁথাছড়াবাসী ছাড়া অন্যকারো পাওয়ার সুযোগ আপাতত নেই। এই ব্রিজটির সুফল ভাসান্যাদম, বগাচতর, গুলশাখালী এবং আমতলীবাসীকে পেতে হলে গাঁথাছড়া থেকে বিলের মধ্যদিয়ে গুলশাখালীর সাথে সংযোগ সড়কটিকে উপযুক্ত করে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে ছোট ছোট আরো কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে, রাস্তাটিকেও উঁচু করতে হবে। লেকের পূর্বপাড়ের সাথে পশ্চিমপাড়ের সংযুক্তির আরো একটি বিকল্প হতে পারে জারুলবাগান থেকে মাইনীমুখ অথবা জারুলবাগান থেকে জালিয়াপাড়াকে সংযুক্ত করে একটি ব্রিজ নির্মাণ। এই একটি ব্রিজ পুরো এলাকার অর্থনৈতিক চিত্রই পাল্টে দিতে সক্ষম। যোগাযোগ ভোগান্তি দূর করে পূর্বপাড়ের মানুষদের জীবনে গতি আনতে এর কোনো বিকল্প নেই। আশা করি স্থানীয় জনগণের প্রাণের এই দাবিটি এবার গুরুত্ব পাবে।

থেগামুখ থেকে মাইনীমুখ সড়ক: বরকলের থেগামুখ স্থলবন্দর থেকে মাইনীমুখ তথা লংগদু পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রাথমিকভাবে সেটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলেও শোনা যায়। কিন্তু দুঃখজনক খবর হচ্ছে, হঠাৎ করেই সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সড়কটি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সড়কটি সরিয়ে নেয়ার খবর প্রচারিত হওয়ার পর লংগদুবাসী নানাভাবে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আজ পর্যন্ত কোথাও লক্ষ করা যায়নি। সম্ভবত অপেক্ষাকৃত কম বাজেটে নির্মাণকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে সড়কটির দিক পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারি পরিকল্পনা বা স্থাপনা নির্মাণ কি শুধুমাত্র কম বাজেটে কিছু একটা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ? মোটেই না, বরং কিছুটা বেশি বাজেট খরচ করে হলেও যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের উন্নয়নকে সম্পৃক্ত করা যায় সেটাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। বর্তমান রুট প্ল্যান অনুযায়ী থেগামুখ থেকে সড়কটি যাবে কাপ্তাই, কাপ্তাই এমনিতেই শিল্প এলাকা; সেখানে এই সড়ক আহামরি নতুন কিছু যোগ করবে না। কিন্তু এটি যদি প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী থেগামুখ থেকে মাইনীমুখ হয়ে খাগড়াছড়ি কিংবা নানিয়ারচর দিয়ে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম জাতীয় সড়কের সাথে যুক্ত করা যায়, তাহলে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ এর সুফল ভোগ করার সুযোগ পেত। শুধু তাই নয়, নানিয়ারচরে চেঙ্গী নদীর উপর ব্রিজটির নির্মাণ শেষ হলে কাপ্তাইবাসীও এই সড়কের সুফল পেতে পারত। থেগামুখ থেকে মাইনীমুখ সড়কটি হলে লংগদু, বাঘাইছড়ি, দীঘিনালা এবং নানিয়ারচরবাসীর ভাগ্য বদলানোর সুযোগ তৈরি হবে। তাই যেকোনো মূল্যে থেগামুখ থেকে মাইনীমুখ সড়কটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বাঘাইছড়ি থেকে ভাসান্যাদম সড়ক: বাঘাইছড়ি থেকে কাপ্তাই লেকের পূর্বপাড় দিয়ে আমতলী, গুলশাখালী, বগাচতর হয়ে ভাসান্যাদম পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে এ সড়কটির নির্মাণ কাজ চলছেও। কিন্তু সেটা এতটাই ধীর গতিতে হচ্ছে যে, সড়কটি কবে পূর্ণাঙ্গরূপ পাবে তার কোনো ধারণা করাও সম্ভব না। এই সড়কটিকে পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে হলে কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমতলীর সাথে গুলশাখালীর সংযোগস্থল ডিপুরমুখ খালের উপর একটি ব্রিজ। ডিপুরমুখ খালের উপর ব্রিজ নির্মাণসহ সম্পূর্ণ সড়কটি দ্রুত নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এই সড়কটি নির্মাণ হলে এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন-মান যেমন বাড়বে, তেমনি এলাকাটির পর্যটন গুরুত্বও বাড়বে। কারণ, সাজেক বর্তমানে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর একটি। সাজেক বেড়ানো শেষে পর্যটকরা বাঘাইছড়ি হয়ে লেকের পূর্বপাড়ের সড়ক দিয়ে ভাসান্যাদম হয়ে সেখান থেকে লঞ্চ কিংবা স্পিড বোটে করে শুভলংয়ের ঝর্ণাগুলোর রূপ দেখতে দেখতে রাঙ্গামাটি পৌঁছাতে পারবে সহজেই। তাছাড়া, থেগামুখ থেকে মাইনীমুখ এবং বাঘাইছড়ি থেকে ভাসান্যাদম সড়ক দুটি গুলশাখালী কিংবা বগাচতর এলাকায় পরস্পরকে আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করে এ এলাকাটির পর্যটনের গুরুত্ব আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

উপরের পাঁচটি দাবি লংগদুবাসীর প্রাণের দাবি। এটা আমাদের যেমন বুঝতে হবে, তেমনি নেতৃবৃন্দকেও আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আর এসব দাবি বাস্তবায়ন হলে লংগদু এলাকার চিত্রটা কতটা আলোকোজ্জ্বল হয়ে দেখা দেবে সেটা কল্পনা করে আমাদের স্বপ্ন দেখা শিখতে হবে। পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। কারণ চাইলেই তো দাবি বাস্তবায়ন হয়ে যাবে না, এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা। আমাদের মধ্যে নানা দল থাকবে, মতভেদ থাকবে; কিন্তু কারো প্রতি হিংসা বা হিংস্রতা থাকবে না, বিদ্বেষ থাকবে না; বরং উন্নয়নের প্রশ্নে সকলে থাকব ঐক্যবদ্ধ- প্রকৃত পক্ষে এলাকার উন্নয়ন চাইলে, পরস্পর মিলেমিশে, সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চাইলে এই শপথ আমাদের নিতেই হবে। আর এটা সম্ভব হলেই লংগদু হবে সুখ-শান্তিময় এক সুন্দর ও সমৃদ্ধ জনপদ।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন