রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি লোকদেখানো: এইচআরডব্লিউ
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
জাতিগত নিধনযজ্ঞের ভয়াবহতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তিকে ‘স্টান্ট’ বা লোকদেখানো হিসেবে আখ্যায়িত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বার্মিজ সংবাদমাধ্যম ইরাবতী বলছে, ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
আর এইচআরডব্লিউ-এর শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে বার্মা এখন তাদের ফিরিয়ে নেবে এমন ধারণা হাস্যকর। এ ধরনের লোক দেখানো পদক্ষেপের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন দেওয়ার কোনও কারণ নেই। তাদের বরং এটা স্পষ্ট করা উচিত যে, নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনও প্রত্যাবাসন হবে না।’
বিল ফ্রেলিক বলেন, নিজ দেশে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে রাখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তাদের জমি ফেরত দেওয়া, ধ্বংস করে দেওয়া ঘরবাড়ি, গ্রাম পুনর্গঠনের মতো শর্ত দিতে হবে। বাস্তবে এগুলো করা হলেও সেনাবাহিনী যদি কয়েক দশকের রোহিঙ্গা নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে না আসে তাহলে নিজ দেশে ফিরতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা কঠিন হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রাখাইনের রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে ভয়ানক জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এ চুক্তিতে উপনীত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাখাইনের ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর অস্ট্রেলিয়াও প্রথববারের মতো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। অসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞের খবরে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধে দোষী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নেপিডোতে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দফতরে দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতায় বলা হয়েছে, দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরুর ব্যাপারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতা হয়েছে। স্বাক্ষরিত ওই সমঝোতায় তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে রোহিঙ্গাদের ফরম পূরণ করতে হবে। সেখানে তাদের রাখাইনে বসবাসের ঠিকানা, জন্ম তারিখ ও পরিবারের সদস্যদের নাম থাকতে হবে। একইসঙ্গে স্বেচ্ছায় ফেরার প্রত্যায়নপত্রও দাখিল করতে হবে তাদের।
এর আগে ১৯৭৮ সালে দু’দেশ চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তির অধীনে দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ছয় মাসের মধ্যে ফেরত গিয়েছিল। পরে ১৯৯২ সালে দু’দেশের মধ্যে সমঝোতায় ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়।
কূটনীতিক ও ত্রাণকর্মীরা চুক্তিটিকে পূর্ণাঙ্গ মনে করছেন না। তারা বলছেন, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা উচিত। ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিজেদের সম্পদ ও বাড়িঘরের নিশ্চয়তা বিধান করারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। কেননা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতার বাস্তবায়ন নিয়ে এরইমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের নিপীড়ক সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। জাতিসংঘের তরফ থেকেও ওই সমঝোতা বাস্তবায়নে ঊর্ধ্বতন সেনা নেতৃত্বের বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচতেই গত ৩ মাসে সোয়া ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা উগ্র বৌদ্ধদেরও এ কাজে লেলিয়ে দিয়েছে।
চীন সফররত মিয়ানমার সেনাপ্রধান হ্লাইং বুধবারও বলেছেন, ‘রাখাইন পরিস্থিতি স্থানীয় রাখাইন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী (মগ) ও বাঙালি (রোহিঙ্গা) উভয়ের কাছে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বরং স্থানীয় রাখাইন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীই মিয়ানমারের সত্যিকারের নাগরিক। ফলে তাদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন