রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা!
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুষ্ঠানে ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন দেশটির সাংবাদিকরা। তবে সরকারি সংবাদমাধ্যমের বাইরে অন্য কারও সে সুযোগ মেলেনি। এতে দেশটির সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে জানিয়েছে মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতী। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন সংকট নিয়ে পাহাড়সম আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র দফতর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এতে বলা হয়, রাখাইনের বাস্তুচ্যুত মানুষদের দেশে ফেরাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের দফতর বিষয়ক মন্ত্রী কিয়াও টিন্ট সোয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বাংলাদেশের মন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকা থেকে যেসব সাংবাদিকরা সেখানে গিয়েছিলেন তারাই শুধু ঘটনাস্থল থেকে এ সংক্রান্ত খবর সংগ্রহ করার সুযোগ পায়। এর বাইরে অনুষ্ঠানস্থলে মিয়ানমারের সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রবেশাধিকার ছিল।
স্থানীয় সংবাদিকদের অভিযোগ, তারা অনুষ্ঠানটির সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কর্মকর্তারা তাদের এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যান। তাদের বিভিন্ন সময়ে স্টেট কাউন্সিলর অফিস, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা বলা হয়। কিন্তু এসব দফতরে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা এক দফতর থেকে অন্য দফতরের কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকরা জানতে পারেন, তাদের ওই অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বার্মিজ সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার-এর নেপিদো ব্যুরো চিফ কো নিয়ান হ্লাইয়াং জানান, কর্মকর্তারা প্রথমে তাদের একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে এ সিদ্ধান্ত বদলে যায়। ফলে স্থানীয় সাংবাদিকদের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়।
অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করতে না পারায় মিয়ানমারের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে বার্মিজ ভাষায় অনুবাদ করে খবর প্রকাশ করে। ঢাকা ট্রিবিউন এবং এএফপি’র খবর অনুবাদ করে প্রকাশ করে ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার।
ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার-এর সাংবাদিক কো নিয়ান হ্লাইয়াং বলেন, সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে তার দেশের সাংবাদিকরা এ চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।
এদিকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ভয়াবহতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে স্বাক্ষরিত এই সমঝোতা চুক্তিকে ‘স্টান্ট’ বা লোকদেখানো হিসেবে আখ্যায়িত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এইচআরডব্লিউ-এর শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে বার্মা এখন তাদের ফিরিয়ে নেবে এমন ধারণা হাস্যকর। এ ধরনের লোক দেখানো পদক্ষেপের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন দেওয়ার কোনও কারণ নেই। তাদের বরং এটা স্পষ্ট করা উচিত যে, নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনও প্রত্যাবাসন হবে না।’
বিল ফ্রেলিক বলেন, নিজ দেশে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে রাখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তাদের জমি ফেরত দেওয়া, ধ্বংস করে দেওয়া ঘরবাড়ি, গ্রাম পুনর্গঠনের মতো শর্ত দিতে হবে। বাস্তবে এগুলো করা হলেও সেনাবাহিনী যদি কয়েক দশকের রোহিঙ্গা নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে না আসে তাহলে নিজ দেশে ফিরতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা কঠিন হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রাখাইনের রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে ভয়ানক জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এ চুক্তিতে উপনীত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।
কূটনীতিক ও ত্রাণকর্মীরা চুক্তিটিকে পূর্ণাঙ্গ মনে করছেন না। তারা বলছেন, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা উচিত। ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিজেদের সম্পদ ও বাড়িঘরের নিশ্চয়তা বিধান করারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। কেননা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতার বাস্তবায়ন নিয়ে এরইমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের নিপীড়ক সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। জাতিসংঘের তরফ থেকেও ওই সমঝোতা বাস্তবায়নে ঊর্ধ্বতন সেনা নেতৃত্বের বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন