রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফেসবুক
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
মিয়ানমারে ২০১৬ সালে দেশটির এক উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির কর্তৃপক্ষ। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় ও জাতিগত উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী উসকানিতেও একটা বড় মাত্রা যোগ করেছেন আসিন উইরাথু নামের ওই ভিক্ষু। আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে মিয়ানমার সরকার তার প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার নিষিদ্ধ করলেও দমে যাননি তিনি। ধর্মীয় ও জাতিগত উগ্রপন্থা ছড়াতে আরও শক্তিশালী মাধ্যম ফেসবুককে বেছে নেন তিনি। এর মাধ্যমে আরও দ্রুত নিজের আক্রমণাত্মক দর্শন ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন ওই ভিক্ষু।
টাইম ম্যাগাজিনের জুন ২০১৩ সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ছিল এই ভিক্ষু। ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয় ‘দ্য ফেস অব বুদ্ধিস্ট টেরর’ বা ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাসের মুখ’। প্রকাশ্য তৎপরতায় নিষেধাজ্ঞা জারির পর প্রতিনিয়ত ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট দিতে শুরু করেন তিনি। তার প্রপাগাণ্ডার বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় ডাহা মিথ্যা কথা লিখে পোস্ট করা। হাজার বছর ধরে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের তুলে ধরা হয় আগ্রাসী বহিরাগত হিসেবে। দ্রুত তার এসব পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে। আর এগুলো পড়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ হয় তার সমর্থকরা।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অসত্য ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ভয়াবহ তথ্যযুদ্ধে লিপ্ত হয় এই ভিক্ষু। এমন বাস্তবতায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে ফের সামনে আসে ফেসবুকের ভূমিকা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, হেট স্পিস বা ঘৃণা উদ্রেককারী মন্তব্য ঠেকাতে ফেসবুকের আরও করণীয় রয়েছে। ব্যবসায়ের পাশাপাশি তাদের মানবাধিকারের প্রতিও নজর দিতে হবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, স্বস্তিকা (হিটলারের নাৎসি দলের প্রতীক)-এর মতো উপাদানগুলো ফেসবুক খুব দ্রুত সরিয়ে নেয়। কিন্তু আসিন উইরাথু নামের ওই ভিক্ষু যখন এটা বলে বেড়ান যে, ‘মুসলিমরা কুকুর’; তখন তারা এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেয় না।
আসিন উইরাথু’র মতো ব্যক্তিদের বিভ্রান্তির প্রচারণার আপডেট পেতেই মিয়ানমারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহু উসকানিমূলক পোস্ট এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি’র মুখপাত্র জ হাতয় ফেসবুক ও টুইটারে কয়েক ডজন পোস্ট শেয়ার করেছেন; যেগুলোতে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেরাই নিজেদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গা নিপীড়নের বহু পোস্ট ফেসবুক আবৃত করলেও এসব জ হাতয়ের এসব পোস্ট অনাবৃতই থাকছে। অথচ রোহিঙ্গা গণহত্যা সংক্রান্ত পোস্টগুলো ফেসবুক থেকেই সরিয়ে ফেলছে এই সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট।
শুধু ছবি বা ভিডিও নয়; এমনকি এ সংক্রান্ত টেক্সট’ও মুছে দেওয়া হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফেসবুকও এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে। একইসঙ্গে তারা ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ (এআরএসএ)-কেও ‘বিপজ্জনক সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। নিজস্ব পর্যালোচনার ভিত্তিতে ফেসবুক এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র। এআরএসএ-এর প্রশংসা করা হয় এমন যে কোনও পোস্ট মুছে ফেলতে প্রতিষ্ঠানটির মডারেটরদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর ও বর্বর হামলা সংক্রান্ত পোস্ট সেন্সর করছে ফেসবুক। এরপরই জানা যায়, এটা ফেসবুকের দাফতরিক সিদ্ধান্ত। তবে মিয়ানমার সরকারের অনুরোধের ভিত্তিতে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে ফেসবুক।
ফেসবুকের দাবি, সন্ত্রাস, সহিংসতা বা গণহত্যার মতো অপরাধে যুক্ত এআরএসএ’র পক্ষে পোস্ট করা তাদের নীতিমালার লঙ্ঘন। তবে অন্য যে পক্ষটির কারণে ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে নিজ বাড়িঘর ফেলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাদের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ফেসবুক। এই পক্ষটিকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা বা তাদের কোনও পোস্ট মুছে দিতে রাজি নয় প্রতিষ্ঠানটি।
সমালোচকরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে ফেসবুক আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ওপরই সেন্সর আরোপ করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির এমন অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে মিয়ানমার। দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি’র মুখপাত্র জাও হাতা তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে আরাকান আর্মি বিষয়ক ফেসবুকের একটি বার্তা শেয়ার করেছেন। ২৬ আগস্টের ওই পোস্টে তিনি আরাকান আর্মি’র পক্ষে যায় এমন যে কোনও ফেসবুক পোস্টে রিপোর্ট করতে বার্মিজদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার ওই পোস্ট প্রায় সাত হাজার বার শেয়ার হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী মোহাম্মদ আনওয়ার। তিনি বলেন, ফেসবুক মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের চেষ্টা করছে। তাদের কাছে বর্মী শাসকগোষ্ঠীর গণহত্যা যেন মজা করার মতো কোনও বিষয়। সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন