রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আটকে আছে কোন জটিলতায়

ঘুমধুম প্রতিনিধি:

গত বছরের ২৫শে আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর গত ছয় মাসে প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এত কম সময়ের মধ্যে এত বেশি মানুষ শরণার্থী হওয়ার ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেনি।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ত্রাণ শিবিরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে খুব একটা আগ্রহী নন। কুতুপালং ক্যাম্পের হাফেজ আলম রাখাইনে সংঘর্ষ শুরুর পর পরই মংডু ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাখাইনে তিনি চালের ব্যবসা করতেন।

দোতলা বাড়ি, গবাদি পশু ও ফসলি জমি-জমা সবকিছু ফেলে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন তিনি। এখন কুতুপালং ক্যাম্পে পান-বিড়ির ছোট দোকান দিয়ে কোনরকম দিন কাটান।

নিজ দেশে সবকিছু ফেলে এসেও মি. আলম বলছেন এই ক্যাম্পের জীবনেই তিনি স্বস্তিতে আছেন। এই মুহূর্তে ফেরার চিন্তাভাবনাও করছেন না তিনি।

বলছেন, “কষ্ট হলেও শান্তি আছে। বার্মায় কোনো স্বাধীনতা আমাদের নাই। এখানেই মুক্ত আছি।”রাখাইনে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসেন নারী ও শিশুরা। টেকনাফে নয়াপাড়া ক্যাম্পে ফাতেমা খাতুনের কাছে নিজ দেশে অবরুদ্ধ জীবনের চেয়ে শান্তির এ আশ্রয় শিবির।

ফাতেমা বলেন, “এখানে অন্তত আমরা শান্তিতে ঘুমাতে পারছি, বুঝেছ? আমরা অনেক কষ্ট পেয়ে এখানে এসেছি। বাড়িঘর জমিজমা সম্পত্তি সব ফেলে এসেছি। আমরা বিচার চাই। বিচার না হলে আমরা আর ফেরত যাব না।”
কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকেই আলোচনায় রয়েছে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তিও হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু কবে থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা এখনো বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, “প্রত্যাবাসন একটি দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া। আমরা ইতোমধ্যে একটা তালিকা তাদের দিয়েছি।”

“সেটা তারা যাচাই করে আমাদের জানাবেন এবং তারপরেই এ অন্যান্য কাজগুলো শুরু হবে। এটাকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটা এমন নয় যে আজই হঠাৎ করে শুরু করবো।”

প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি বলতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারে কিছু ঘরবাড়ি তৈরির কাজ হয়েছে। আর রোহিঙ্গাদের নদীপথে ফেরত পাঠাতে গত সপ্তাহে টেকনাফের কেরণতলী প্রত্যাবাসন ঘাট নির্মাণে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে চুক্তি করার কথা জানালেও সেটি এখনো হয়নি। তবে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো তাড়াহুড়ো দেখতে চায় না জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা।

কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র ক্যারোলিন গ্লাক বলেন, “এটা ইতিবাচক যে দু’দেশের মধ্যে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো তড়িঘড়ি করা ঠিক হবে না। প্রত্যেকেকেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিতে হবে, কেউ কেউ হয়তো অনেকের চেয়ে আগে ফিরে যেতে চাইবে।”

দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আছে স্বেচ্ছায় যারা যাবে তাদেরকেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু ত্রাণ শিবিরে জানতে চাইলে কেউই যাবার আগ্রহ দেখায় না এবং এ ব্যাপারে সবার বক্তব্য একই রকম।

তারা নাগরিকত্ব, রোহিঙ্গা হিসেবে মেনে নেয়া এবং নির্যাতনের বিচারসহ বেশকিছু শর্ত সামনে আনছেন।
স্বামী হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে আসা রহিমা বলেন, “আমাদের আর যাবার কথা বলো না। বরং আমাদের এখানেই গুলি কর।”

স্বামী-সন্তান নিয়ে সেনোয়ারা এসেছেন সেপ্টেম্বরের শুরুতে। আসার পথে তার স্বামীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাঁধে আঘাত করা হয়। স্বামীকে দেখিয়ে সেনোয়ারাও বলছিলেন, “বেশি কষ্ট পাইছি। আর যাব না। বরং তোমরাই মেরে ফেলো।”

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর পর ক্যাম্পে ফেরার শর্ত তুলে ধরে একাধিক মানববন্ধনের খবর পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক খুন পর্যন্তও গড়িয়েছে।

দেখা গেছে প্রবীণ এবং গণ্যমান্য রোহিঙ্গারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ফেরার প্রশ্নে তাদের দাবি-দাওয়া কী হবে সেটিও বোঝানোর কাজটি করেছেন।

ফেরার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের এমন অবস্থান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি জটিল করবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এছাড়া প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও নানারকম প্রশ্ন উঠছে।

বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে গত ছ’মাস ধরে আটকা পড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ১৬ই জানুয়ারি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে এক বৈঠকে ঐকমত্য হয়েছিল।

২০ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে আরেকটি বৈঠকের পর বলা হয় মিয়ানমার তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে।

কিন্তু ২২শে ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, জিরো লাইনে অবস্থানরত ছয় হাজার ৫০০ শরণার্থীর মধ্যে শত শত ‘সন্ত্রাসী’ রয়েছে। কথিত জঙ্গী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নেতা এবং তাদের আত্মীয় স্বজনরাও সেখানে আছে। এ অবস্থায় তাদের গ্রহণ করার আগে সতর্কভাবে মিয়ানমার সরকার যাচাই বাছাই করবে বলে বলা হচ্ছে।

যদিও দু’দেশের কর্মকর্তাদের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জিরো লাইনে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফেরত নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কেননা এরা এখনও সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার ভূখণ্ডের ভেতরেই রয়েছেন।

মিয়ানমার সরকারে এ বক্তব্যে জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হলো বলেই মনে করা হচ্ছে।
সর্বোপরি গত ২৫ আগস্টে সংকট শুরুর পর ছ’মাসের মাথায় এসে এখনো বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন