রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো এখন মগদের দখলে

 
 আমানুর রহমান রনি, রাখাইনের তমব্রু থেকে ফিরে
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:রাখাইনের তমব্রুতে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো একের পর এক পুড়িয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগ নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা । তেমন একটি গ্রামে ঢুকে নিজ চোখে দেখছি সেই তাণ্ডব। সঙ্গী দুই রোহিঙ্গা জানালেন তাদের তাড়িয়ে দিয়ে এসব গ্রামের নিয়ন্ত্রণ এখন মগদের কাছে দিয়েছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। সুযোগটা লুফে নিয়েছে মগরা। তাদের চ্যালেঞ্জ এখন রোহিঙ্গাদের আর দেশে ঢুকতে না দেওয়া। রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা ঠেকাতে তাদের গ্রামগুলো এখন পাহারা দিচ্ছে মগরা।

হাঁটতে হাঁটতে দুই রোহিঙ্গা সহযোগী জানালেন, তাদের সরকার, সেনাবাহিনী, পুলিশ কেউ আর চায় না তারা দেশে থাকুক। তাই একেবারে উচ্ছেদ করে মগদের এসব এলাকা দিয়ে দিয়েছে ওরা। এগুলো এখন মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। আর মগদের সহায়তা করতে তাদের হাতে বিভিন্ন সরঞ্জাম তুলে দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। সীমান্তের আশেপাশে মাইন পুঁতে রাখার কাজেও সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে মগরা। সঙ্গে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তায় সে চিহ্ন আমি দেখেছি। এধরনের একাধিক তথ্য ও চিত্র আমি পেয়েছি।

গত বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে যখন আমি তমব্রুতে প্রবেশ করি সেই সময় সীমান্তের বেশ কয়েকটি জায়গায় স্থলমাইন পুঁতে রাখার গর্ত দেখেছি। এর মধ্যে একটি বিস্ফোরিত হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর। সঙ্গী রোহিঙ্গাদের একজন জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসার সময় একজন রোহিঙ্গা নারী অসতর্কভাবে ওই স্থলমাইনে পা ফেলায় গুরুতর আহত হন। তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এখন চিকিৎসাধীন।
তমব্রু এলাকায় ঢুকে উত্তর দিকের পাড়াগুলোতে মগদের পাহারা দিতে দেখেছি। সঙ্গী দুই রোহিঙ্গা সহযোগী জানিয়েছেন, তাদের হাতে সবসময় দা থাকে। ওদের দেখা মাত্রই আমার সঙ্গে থাকা রোহিঙ্গা সহযোগীরা দ্রুত নিজেদের আড়াল করে। আমিও বিপদ বুঝতে পেরে দ্রুত পাহাড়ের আড়ালে চলে যাই।

তমব্রু এলাকায় কোনও কোনও পাহাড়ের কোলে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘরের চিহ্ন থাকলেও সেখানে ঘরের ভেতরে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। রোহিঙ্গাদের পাড়াতে আগুন দেওয়ায় এসব গ্রামের গাছ পুড়ে বাদামি বর্ণের হয়ে গেছে। সেই গাছগুলো দেখলেই বোঝা যায়, সেখানে আগুনের তীব্রতা কত ছিল। রোহিঙ্গাদের উঠানগুলোতে নারকেল, কাঁঠাল ও সুপারি গাছ বেশি দেখা গেছে। তবে আগুনের লেলিহান শিখায় এসব গাছের একটিও সবুজ নেই।

আমি যে গ্রামগুলোতে বৃহস্পতিবার গিয়েছি সেখানে গত ২৬ ও ২৭ আগস্ট বিশাল বহর নিয়ে এসেছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এসময় একসঙ্গে সবগুলো গ্রামে তাণ্ডব চালায় তারা। এরপর মগরা গ্রামগুলোতে আগুন দেয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে রোহিঙ্গারা সবাই জান নিয়ে পালিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তে। বাংলাদেশের ঘুমধুমের গ্রামগুলো তমব্রুর পাহাড় থেকে দেখা যায়। তাই তমব্রুতে যখন রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া হয়, গুলি করা হয় তখন ঘুমধুমের বাংলাদেশি মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে বলে ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি।

আমি তমব্রুর উত্তর দিক দিয়ে ঘুরে যখন পূর্বদিকের গ্রামে হাঁটছি পাহাড়ে পাহাড়ে থাকা রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে দেওয়া সব ঘর প্রায় মাটির সঙ্গে কাঠামোগুলো মিশে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে মাটির ঘরগুলো ধুয়ে যাচ্ছে। সামনে পেছনে তাকাচ্ছি, আর হাঁটছি।

আমি তখনও সীমান্তের অনেক ভেতরে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মগ শিশুরা একটি স্কুলের মাঠে খেলছে। সঙ্গীরা জানালেন, স্কুলটা শুধুই মগ শিশুদের জন্য। সেখানে মগ নৃ-গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে। স্কুলের সামনে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিপি’র বাংকার। আরেকটু স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টা করছি, মোবাইল থেকে ছবি তুলছি। ফিসফিস করে কথা বলছি, রোহিঙ্গা দুই সহযোগী আমাকে জানালো, ওদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র আছে। গ্রামে মানুষ আসলে ওরা টের পেয়ে যায়। সামনে যাওয়া যাবে না। আমি একজনকে প্রশ্ন করলাম, কিভাবে টের পায়? সেটা আবার কেমন যন্ত্র? তবে তারা কিছুই বলতে পারলো না। এমন কোনও যন্ত্র আছে কিনা আমার জানা নেই।তবে ধারণা করছি, দূরবীনসহ দ্রুত তথ্য পাঠানোর নানা ধরনের যন্ত্র কাছে রেখেছে তারা।

আমি যখন যে গ্রামে প্রবেশ করেছি সেখানে দ্রুততার সঙ্গে চারপাশ দেখার চেষ্টা করেছি। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। আমি থাকতে চাইলেও সঙ্গী রোহিঙ্গা আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখানে থাকতে দেননি। তাই দ্রুত বের হয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। এই অবস্থায় পূর্বপাড়ায় আমি একসঙ্গে চারটি ঘর দেখলাম। একটা পাহাড়ের ওপরে। পাহাড়টির গায়ে দেখতে পেলাম বুট জুতার চিহ্ন। বোঝাই যায়, এসব বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আরও সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো তমব্রুর কিছু ন্যাড়া পাহাড়, আবার কিছু পাহাড়ে ঘন জঙ্গল।

তমব্রুতে পাহাড়ের মাঝখানে মাঝখানে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। এসব জমি রোহিঙ্গাদের। তারা জমিতে চাষাবাদও করেছিল। কিন্তু, হামলার কারণে সব ফেলে চলে আসতে হয়েছে পরবাসে। মাঠে ধানের চারাগুলো হাঁটু সমান বড় হয়েছে। এই মাঠে আর কিছুদিন পর হেমন্তের রোদ্দুরে ঝলমল করবে সোনালী ধানের শীষ। কিন্তু সেই ধান কেবলই কষ্ট বাড়াবে কুতুপালংয়ের শরণার্থী শিবিরে পড়ে থাকা অসংখ্য রোহিঙ্গার মনে। বর্গীদের মতো মগরা এসে লুট করে নেবে এই সোনার ফসল। আমার সঙ্গে থাকা রোহিঙ্গা নূর ইসলাম আমাকে তার ধানের ক্ষেত দেখিয়ে বলেন, ‘এই মাঠের ধান আর কাটতে পারবো না। এসব মগরা নিয়ে যাবে।’ তার চেহারা বিষণ্ন, মুখটা তখন পুড়ে যাওয়া গাছগুলোর চেয়ে কালো। কিছুক্ষণ একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উভয়ের চোখেই অসহায়ত্ব। তার অসহায়ত্ব সব ফেলে যাওয়ার, আমার অসহায়ত্ব তাকে কোনোরকম সাহায্য করতে না পারার।

পাহাড় আর জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে সবাই হাঁপাচ্ছি। আবার আগুন আতঙ্ক। এবার উত্তর পাড়ায় আগুন দিয়েছে মগরা। সঙ্গে নিশ্চয় সেনাবাহিনী। গুলির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। এ মূহুর্তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঝিয়ে দিলো আরও সতর্ক হওয়ার জন্য।এ মুহর্তে মনে হলো এপারে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমিও বিপদে পড়তে পারি। অভিযান শেষ। এবার ফিরে আসতে হবে। আরও দ্রুত হাঁটছি। জঙ্গলের পথ ধরে সীমান্তে আসার চেষ্টা করছি। হাঁটতে হাঁটতেই আমার সহযোগীরা জানালো উত্তর পাড়ায় কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়েছে। এর আগে কয়েকবার নাফ নদীতে রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর জ্বলতে দেখেছি। তখন ছিলাম বাংলাদেশ সীমান্তে। এবার মিয়ানমারের ভেতরে থেকেই আগুন দেখা। দ্রুত ঘুমধুমের দিকে ফিরে আসছি। সামনেই মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। এবার আগুনের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা নিলাম। কাঁটাতারের পাশ ধরে হাঁটছি।

ঘুমধুমের পাশ দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে কড়াকড়ি নেই দেখে সহযোগীদের বিদায় করলাম। এবার আমি আর ফটোগ্রাফার বিপ্লব দীক্ষিত দাদা। দুজনেই ধোয়া দেখতে পেলাম। দ্রুত সামনের দিকে যাচ্ছি। রোহিঙ্গাদের নারী শিশুদের বিলাপ। গুলির শব্দ। কয়েকটি ঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। মানুষ মানুষের বসতি পুড়ছে এমন দৃশ্য! ভিডিও করছি জঙ্গলের আড়ালে থেকেই। আগুন বেড়েই চলছে। নিজের ঘর পুড়তে দেখে কাঁটাতারের পাশে অচেতন নাসিমা খাতুন। তার সন্তানরা এবার মাকে বাঁচানোর চেষ্টায়। পাহাড়ের ঢাল থেকে পানি তুলে তার মাথায় দিচ্ছে। তাকে তুলে বাংলাদেশে সীমান্তে নিয়ে আসা হলো। মাটিতেই শুয়ে আছেন নাসিমা খাতুন। দূর থেকে আমাদের বিজিবি বারবার আমাদের চলে আসতে বলছেন। তাই এবার চলে আসতে হলো। ঘুমধুমের রাস্তায় এসে গাড়ি পাচ্ছি না। সামনে হাটতে থাকলাম। এবার একটি ব্যাটারি চালিত রিকশায় উঠলাম। বিস্তর অভিজ্ঞতা, মানুষের কান্না সঙ্গে নিয়ে ভারাক্রান্ত দুজন ফিরছি।

অটোতে বসে মনে মনে ভাবছি, দুঃসংবাদ সংবাদকর্মীর জন্য যতই বড় সংবাদ হোক, এমন সংবাদ আর করতে চাই না। অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য তাই প্রার্থনা। (শেষ)

( সম্পাদকের নোট: মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল আসছে বাংলাদেশে। আমাদের প্রতিবেদক আমানুর রহমান রনি এই নির্মমতার উৎসমূল মিয়ানমারের রাখাইনের তমব্রুতে গিয়ে দেখে এসেছেন। সাংবাদিকতার স্বার্থে ও মানবতার কারণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।)

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন