রাঙামাটি জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিনিধি:

রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের অভিযোগ তোলেছেন ভুক্তভোগিরা। আর এসব অভিযোগের মধ্যেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে। এতে ৭৭ শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়েছে ৮০ শিক্ষকের। তবে “প্রমাণ পেলে” অভিযুক্তদের নিয়োগ বাতিল করা যাবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রওশন আলী।

অবশ্য এর আগে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য কোটা না মানায় নিয়োগের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে। নিয়োগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলেও জানান, নিয়োগ বঞ্চিত কয়েক জন।

ফলাফলেও দেখা গেছে, নানা রকমের হেরফের ও গোঁজামিল। যেমন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় ২২ শূন্য পদে নেয়া হয়েছে ১৭ জন, জুরাছড়িতে ৬ জনের স্থলে ৫ জন, বিলাইছড়িতে ৫ জনের স্থলে ৪ জন, কাউখালীতে ২ জনের স্থলে ৯ জন। আবার লংগদু উপজেলায় ১২ জনের শূন্য পদের স্থলে নেয়া হয়েছে ১৫ জন, নানিয়ারচরে তিন জনের স্থলে ৫ জন, কাপ্তাই ও রাজস্থলীর প্রতি উপজেলার ২ জনের স্থলে ৩ জন করে।

আবার লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও চাকরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিলাইছড়ি উপজেলার (রোল-৫৯) লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেননি, অথচ তার নাম উত্তীর্ণের তালিকায় ওঠে। পরে অনেকের আপত্তির মুখে সংশোধীন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা বাতিল ঘোষণা দিতে বাধ্য হতে হয়েছে। নানিয়ারচর উপজেলায় একই পদে চাকরি করতেন, তা থেকে ইস্তফা দিয়ে এবার সদর উপজেলায় আবেদন করেছেন (রোল-২৮), তার চাকরি হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যক্ষর্শী একজনের দেয়া তথ্য মতে, স্থায়ী বাসিন্দাকে নিয়োগের শর্ত থাকলেও নিয়োগ পাওয়া শর্মিলা চক্রবর্তী স্থানীয় নন। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। লিখিত পরীক্ষার পর এবং চূড়ান্ত ফলাফলের আগেই চাকরি নিশ্চিত হওয়ায় মিষ্টি বিতরণ করেন শর্মিলা চক্রবর্তী। স্থানীয় আরও অনেকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যমান শূন্য পদ পূরণে চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি ৭৭ সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা। এতে মৌখিক পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়েছে ৫০৩ জনকে। মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর বাঘাইছড়ি ও লংগদু, ২০ সেপ্টেম্বর বরকল, কাউখালী ও নানিয়ারচর এবং ২১ সেপ্টেম্বর সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলার প্রার্থীদের। মৌখিক পরীক্ষার শেষ দিনের রাতে চুড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে ৭৭ শূন্য পদে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে দরখাস্ত আহবান করা হলেও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত ফলাফলে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৮০ জনকে।

এদিকে ১৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য কোটা সংরক্ষণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন না করার অভিযোগে এবং নিয়োগের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে জেলা যুগ্ম জজ আজিজুল হকের আদালতে মামলা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু।

মামলার বিবাদী করা হয়েছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে। মামলার দিন নোটিসপ্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শানোর আদেশ দেন আদালত। শিক্ষক নিয়োগের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে অচিরেই আদালতে আরেকটি মামলা করবেন বলে জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু। নিয়োগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলেও জানান, নিয়োগ বঞ্চিত কয়েক জন।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদর উপজেলা কমান্ডার মিজানুর রহমান বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটা সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করার পাশাপাশি এবার শিক্ষক নিয়োগে ভুয়া কাগজপত্রে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য দেখিয়ে অনেককে চাকরি দিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করা হয়েছে।

নিয়োগ বঞ্চিত হওয়া সাধারণ প্রার্থীসহ তাদের অভিভাবকদের অভিযোগ, যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও বারবার চাকরি থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাদের। চাকরির আবেদন করে নিয়োগ পরীক্ষার নামে হয়রানি করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। যাদের চাকরি হচ্ছে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে এবং দলীয় ও আত্মীয়তার বলে। এখানে যোগ্যতা ও মেধার কোনো মূল্যায়ন নেই। এসব স্বজনপ্রীতিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়, যা নিয়ে জড়িত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তরা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শুক্রবার রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমার ব্যবহার করা মুঠো ফোনের ও নম্বরে বারবার কল দিয়েও তখন নম্বর দু’টি বন্ধ পাওয়া যায়।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রওশন আলী বলেন, আমার জানা মতে এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্ত প্রার্থীদের নিয়োগ বাতিল করা যাবে।

৭৭ শূন্য পদে ৮০ জনের নিয়োগ এবং কোনো কোনো উপজেলায় কম বেশী সংখ্যক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে নিয়োগ কমিটির এখতিয়ার রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটা সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন না করার অভিযোগ করা মামলায় আদালতের দেয়া আদেশে এরই মধ্যে জবাব দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন