রাখাইনের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন সু চি

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

দীর্ঘ সময় পর অবশেষে গোলযোগপূর্ণ রাজ্য রাখাইনের জন্য সরকারের নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন অং সান সু চি। এটি আসলে রাখাইন প্রশ্নে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে ঘিরে দীর্ঘ প্রতিশ্রুত রোডম্যাপ। অং সান সু চি’কে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন তদারকির জন্য তৈরি কমিটির প্রধান করা হয়েছে।

ছয় সপ্তাহের বেশি আগে কফি আনান তার প্রতিবেদন দাখিল করার পর পশ্চিম রাখাইনের সঙ্ঘাত-জর্জরিত এলাকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও অবিশ্বাসের মূল কারণ দূর করা এবং গত আট সপ্তাহে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রমকারী পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের নীল নক্সা প্রণয়নের জন্য সরকার কাজ করছে।

বিদেশী সহায়তায় বেসামরিক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এর নাম ‘হিউমেনেটিরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স, রিসেটলমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন রাখাইন স্টেট।’ এই সংস্থা উদ্বাস্তুদের সহায়তা করবে, তাদের প্রত্যাবর্তন তদারকি করবে, তাদের পুনবসতি স্থাপনে সাহায্য করবে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে অং সান সু চি এই ঘোষণা দেন।

সরকারের অভ্যন্তরের সূত্র জানিয়েছে, অং সান সু চির পরিকল্পনাজুড়ে ছিল কফি আনানের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের কথা। তবে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ করার দিনটিতেই নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এবং এর জের ধরে লাখ লাখ লোক বাংলাদেশে পাড়ি দেওয়ায় সরকার বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে, সম্ভবত দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি করে।

উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন ও পুনবসতি স্থাপনের কাজ শুরু করার আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। আরো বড় ইস্যুগুলো মোকাবিলার আগে বাংলাদেশ ও রাখাইনের উদ্বাস্তুদের মানবিক সহায়তাই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজ।

আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি [আরসা] গত আগস্টে হামলা চালানোর পর কী করা উচিত, সেটা ভাবতে ভাবতেই সময় অপচয় করেন অং সান সু চি। সরকারি পরিকল্পনার সাথে জড়িত সু চির এক সিনিয়র উপদেষ্টা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সু চি মুসলিমদের দুর্দশায় সবসময় কাতর। তিনি রাখাইনের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তবে সমস্যার সমাধান কিভাবে করতে হবে, তা-ই বুঝতে পারছেন না।

এই সঙ্কটকে ঘিরে আছে রাখাইনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল নিয়ে অং সান সু চি, আর সামরিক বাহিনীর মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্ব। সামরিক বাহিনী এখনো রাখাইনে ‘জরুরি অবস্থা’ জারির ব্যাপারে জোর দিচ্ছে। সেটা করতে পারলে রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা আরো ক্ষমতা পাবে। তবে সু চি তা প্রতিরোধ করে আসছেন। এমনকি সামরিক বাহিনী যাতে কিছু একটা করার সুযোগ না পায়, সেজন্য গত মাসে তিনি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনেও যোগ দেননি।

এখন অং সান সু চি এবং তার সরকার বেসামরিক প্রশাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করেছে। তিনি তার বক্তৃতায় পরিষ্কার করেছেন, এটা মিয়ানমারের নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ। অবশ্য এতে আসিয়ান, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘের অংশবিশেষসহ কিছু আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ রয়েছে। এটা একটা জাতীয় প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক, বেসরকারি খাত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও, নাগরিক সমাজের সংস্থাগুলোকেও অংশ নিতে বলা হয়েছে।

নবগঠিত কমিটির প্রধান হওয়ার মাধ্যমে অং সান সু চি ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর অর্থ হলো, রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে তার সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর মধ্যে রয়েছে, আরাকানে সব জাতিগত ও ধর্মীয় গ্রুপের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা। এতে বৌদ্ধ ও মুসলিম উভয় ধরনের শিক্ষক থাকবে, মিয়ানমার এবং স্থানীয়- উভয় ভাষাই শেখানো হবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী উচ্চ মানের হাসপাতাল ও ক্লিনিকও প্রতিষ্ঠা করা হবে।

চূড়ান্ত পর্যায়ে হবে পুনঃবসতি স্থাপন। জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯০ সালের সমঝোতার আলোকে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা হবে। উল্লেখ্য, ওই সময় যেসব মুসলিম উদ্বাস্তু পালিয়ে গিয়েছিল, ওই সমঝোতার আলোকে তাদেরকে ফেরার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এটা প্রত্যায়নের সাথেও সম্পর্কিত। এই কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে এই অঞ্চলের উন্নয়ন সাধন এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা। সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, সামরিক বাহিনীরও একটি ভূমিকা থাকবে। তাদেরকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হবে। তবে তাদের মূল কাজ হবে নিরাপত্তার যোগান দেওয়া। অং সান সু চি দৃঢ়ভাবে বলেন, এটা হবে বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সমন্বয় সাধন প্রক্রিয়া।

মানবিক সহায়তা প্রদানের কাজ ইতোমধ্যেই পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে, জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। রেড ক্রস মুভমেন্টের সহযোগিতায় সরকারি ব্যবস্থাপনাও গড়ে ওঠেছে। ইতোমধ্যে তারা মানবিক সহায়তা প্রদান শুরু করেছে। এটা আঞ্চলিক মন্ত্রিপর্যায়ের কমিটি, নেতৃত্বে রয়েছেন সমাজকল্যাণ, ত্রাণ, বসতি স্থাপনবিষয়ক মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয়ে। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন নতুন কমিটির তিনি ভাইস চেয়ারম্যান। উদ্বাস্তুদের কল্যাণ এবং রাখাইনে তাদের বসতি স্থাপন করার নতুন সুযোগে যাতে কোনো জটিলতা দেখা না দেয়, সেজন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

রাখাইনের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থতার জন্য সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সমালোচনায় কষ্ট পেয়েছেন সু চি। এই সমালোচনা বর্তমান দফার সহিংসতার আগেই শুরু হয়েছে। গত বছর থেকেই রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নৃশংস দমন অভিযানের জন্য নোবেলজয়ীর তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এই নৃশংসতার কারণেই মুসলিম উদ্বাস্তুরা ঢলের মতো বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাতে তিনি হতাশ ও ক্রুদ্ধ হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার তার দেওয়া বক্তৃতাতেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের বিরুদ্ধে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিমত উপলব্ধি করা প্রয়োজন আমাদের। তবে একজনও আমাদের দেশে আমরা কিভাবে কাজ করছি, তা বুঝতে পারছে না। আমাদের দেশের শান্তি ও উন্নয়নের আকাঙ্খা অন্য যে কারো চেয়ে আমাদের অনেক বেশি।’

এই নতুন উদ্যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাখাইনের পুরো সমস্যা সমাধান করা। আর সরকার আশা করছে, এতে করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি তীব্র সমালোচনা কমবে, রাখাইন পরিস্থিতির কারণে নতুন করে আন্তর্জাতিক অবরোধ, বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে, আরোপ করা হবে না। তিনি পরিকল্পিতভাবে সমালোচনা এড়িয়ে গেছেন, এমনকি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি তার বক্তৃতায় কোনো সমালোচনা করেননি।

বিশেষ করে বহির্বিশ্বে ধারণা রয়েছে, তিনি সামরিক বাহিনীর পক্ষে রয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ বলছেন, তিনি তাদের পকেটে বন্দি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সু চির ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানান, তিনি যে পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন, তা তার বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার অংশবিশেষ। তিনি এখন ভবিষ্যতের দিকে নজর দিতে চান। তিনি কথা না বলে কাজের মাধ্যমে সমালোচনার জবাব দিতে চান। তিনি তার বক্তৃতায় বলেছেন, রাখাইনে অনেক কিছু করার আছে।

ওই ব্যক্তি জানান, তিনি জ্বালাময়ী ও বিভাজন সৃষ্টিকারী মন্তব্য এড়াতে চান। তিনি পুরো জাতির কাছে বৌদ্ধ মূল্যবোধ তুলে ধরতে পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশে ও দেশের বাইরের মিয়ানমারের জনগণ মেত্তা (দয়ালু চিত্ত) ও থিতসা (সত্য) দিয়ে সহায়তা করবে।

এর লক্ষ্য হলো বৌদ্ধ ধর্মের ভালোবাসা ও আর সহানুভূতির আদর্শকে সামনে রেখে তিনি এগিয়ে যেতে চান। তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে চরমপন্থীদের হাত থেকে বের করে আনতে চান বলে তার বক্তৃতা প্রস্তুতিতে জড়িত এক কর্মকর্তা বলেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, আমাদের জনগণ তাদের উদারতা লোকহিতৈষীর জন্য সুপরিচিত। শুধু তা-ই নয়, তারা এ ব্যাপারে বিশ্বে এক নম্বর। আমরা আমাদের জনগণের উদারতার সদ্ব্যবহার করব।

অর্থাৎ সু চি দৃঢ় বেসমারিক নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাধানের কথা বলেছেন। তবে তিনি তার বক্তৃতায় জোর দিয়েছেন, নতুন উদ্যোগ কথায় নয়, আমাদের কাজের মাধ্যমে’ মূল্যায়িত হবে। আর কেবল রাখাইনের জন্য নয়, পুরো মিয়ানমারের ক্ষেত্রেই এই উদ্যোগ প্রয়োগ করার জন্য জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, দেশ ও গণতন্ত্রায়নের ভবিষ্যত নির্ভর করছে এর ওপর।

তিনি জাতিকে বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি দৃঢ়সংকল্প, প্রত্যয়, জ্ঞান, সাহসিকতা ও তেজদীপ্ততার শক্তি ব্যবহার করার মতো সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। আমরা সত্য ও বিশুদ্ধতার শক্তি ব্যবহার করব, যাতে এই উদ্যোগ আমাদের ইতিহাসের ‘মাইলফলকে’ পরিণত হয়।

 

সূত্র: south asian monitor

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন