যৌথ কম্বিং অপারেশনে পরিচালনা করছে জেএসএস-ইউপিডিএফ?

নির্বাচন পরবর্তী অভিযান, ভয়াবহ নাশকতার আশঙ্কা

আরিফুল হক মাহবুব, কাউখালী:

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন প্রসীত বিকাশ খীসার ইউপিডিএফ ও সন্তু লারমার জেএসএস অত্যন্ত মারমুখী হয়ে উঠেছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যারা ভিন্ন প্রতীকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে যৌথ কম্বিং অপারেশনের ঘোষণা দিয়েছে ইউপিডিএফ ও জেএসএস। দীর্ঘদিন সাপে নেওলে সম্পর্কে থাকা দল দুটি অঘোষিতভাবে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েও আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়। এতে দলদুটি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে যেসব উপজাতীয় জনগণ দল দুইটির প্রার্থিদের ভোট দেয়নি এবং যেসকল ব্যক্তি ও সংগঠনের কারণে তাদের নির্বাচনী আধিপত্য বিস্তারে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তাদের প্রতি বেশী ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গেল নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর ভরাডুবির পর মারমূখী হয়ে উঠেছে উপজাতীয় সংগঠন দুটি । নির্বাচনে হারের কারণ অনুসন্ধান করতে এবং দল দু’টির নির্দেশনা অমান্য করে যেসব ব্যক্তি ভিন্ন প্রতীকে ভোট প্রদান করতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচনের পর পরই ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বেশ কয়েদফা বৈঠকের কথা নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।

গত ০১ জানুয়ারি রাঙ্গামাটি শহরের রাজবাড়িস্থ সাবারাং হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জেএসএস মনোনীত পরাজিত প্রার্থি উষাতন তালুকদার হুমকি দিয়ে বলেন, ফলাফল বাতিল করা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে দায়ী থাকবে।

তার এ ঘোষণার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন হতাহত হয়েছে। এতে করে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউখালী, নানিয়ারচর, মহালছড়ি, পানছড়ি, দিঘীনালা ও বাঘাইছড়িতে যেকোনো মূহুর্তে বড় ধরণের নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কা সর্বত্র বিরাজ করছে। এতে জনপ্রতিনিধি, সরকারী স্থাপনা বা পর্যটকগণ টার্গেটেড হতে পারেন।

উল্লিখিত এলাকায় কম্বিং অপারেশন জোরদার করতে গত ১০ জানুয়ারী বিকাল ৩টায় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার দূর্গম শুকনাছড়ি পাড়ায় বৈঠক করে প্রসীত বিকাশ খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও সন্তুলারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। বৈঠকে জেএসএস’র রাঙামাটি জেলার সামরিক কমান্ডার আশাপূর্ণ চাকমা, কেন্দ্রীয় সদস্য উথোয়াইচিং মারমা, কাউখালী উপজেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুদিপ্ত চাকমা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ইউপিডিএফ’র পক্ষে উপস্থিত ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব সজীব চাকমা, কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক রবি চন্দ্র চাকমা, কাউখালী ইউনিটের পরিচালক কার্তিক চাকমাসহ আরো অনেকে।

সমন্বিত বৈঠকে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বিগত নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে সমর্থনকারী সংস্কারপন্থী জেএসএস (এমএন লারমা) ও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামীলীগকে সমর্থনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমূহের বিরুদ্ধে যৌথ কম্বিং অপারেশনের ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চলে চলছে ধারাবাহিক হামলার ঘটনা।

নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষের ঘটনায় জেএসএস (সন্তু) কর্তৃ হত্যা করা হয় বাঘাইছড়ির জেএসএস সংস্কারপন্থী নেতা বসু চাকমাকে। ইউপিডিএফ কর্তৃক ব্রাশফায়ারের শিক্ষার হয়েও প্রাণে বেঁচে যান খাগড়াছড়ির দীঘিনালা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নাজির উদ্দিন। সবশেষ ১৩ জানুয়ারী দিঘীনালার মেরুং ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় মারাত্মক আহত হন অন্তত তিন বাঙ্গালী। এছাড়াও কাউখালী উপজেলার দূর্গম হারাঙ্গী এলাকায় ফেরীতে মাল বিক্রি করতে যাওয়া এক বাঙ্গালীর কাছে ১০ হাজার চাঁদা দাবী করে সন্ত্রাসীরা। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাকে মারধর করে পাহাড়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করে দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। আতংকিত লোকজন লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ভিতরে(দূর্গম এলাকায়) প্রবেশ করতে পারছে না। একইভাবে ভেতর থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লোক ব্যবসায়িক কাজে বের হতে পারছে না। শত নির্যাতনের পরও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। প্রাণের ভয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সহায়তাও নিতে পারছে না। এসব বিষয়ে ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র বেশ কয়েকজন নেতার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের সংযোগ পাওয়া যায়নি।

সূত্র মতে, আন্তঃদলীয় সংঘাত নিরসনে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অঘোষিত অস্ত্র বিরতি শুরু করে ইউপিডিএফ ও জেএসএস। যার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাহাড়ের আসনগুলোতে ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দেয় দল দুটি। কিন্তু ভয়ভীতি ও শত বাঁধা বিপত্তির মুখেও নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আদায় করতে ব্যর্থ হয় আঞ্চলিক দুটি সংগঠন। ফলে নির্বাচনের পর থেকে যৌথ কম্বিং অপারেশনের ঘোষণা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে পাহাড় জুড়ে সাধারণ পাহাড়ী- বাঙ্গালীর মাঝে ব্যাপক আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। সৃষ্ঠ পরিস্থিতি কঠোর হাতে দমন করা না গেলে পাহাড়ের আইনশৃংখলার মারাত্মক অবনতির আশঙ্কা করছে অধিবাসীগণ।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, জেএসএস, নির্বাচন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন