যেভাবে বদলে গেলো বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট


পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

বিস্মিত না হয়ে আর উপায় থাকছে না। কারণ, সম্প্রতি এশিয়া কাপ জয় এবং বিশ্বকাপ বাছাইয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বলা যায় সাফল্যের শিখরে আরোহণ করছে টাইগ্রেসরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডে, টি-২০ দুই সিরিজেই ধবলধোলাইয়ের পর কোন জাদুর কাঠির স্পর্শে অমন বদলে গেল বাংলাদেশের মেয়েরা!

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরটা ছিল গত মে মাসে। পরের মাসেই মালয়েশিয়ায় এশিয়া কাপে ভারতকে দুবার হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন, আয়ারল্যান্ডে গিয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ ম্যাচে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় এবং সর্বশেষ হল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। একের পর এক সাফল্যে রীতিমতো উড়ছেন সালমারা। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় ভূপাতিত দল এমন উড্ডয়নের পাখা পেল কোথায়?

বলতে পারেন, এশিয়া কাপ জয়ের সাফল্যই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে ক্রিকেটারদের মনোজগতে। ২১ বছর আগে মালয়েশিয়ায় আইসিসি ট্রফি জিতে শুরু বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বপ্নযাত্রা। সেই মালয়েশিয়াতেই মেয়েদের এশিয়া কাপ জয় দিয়ে যেন শুরু হলো আরেক বিপ্লব।

কিন্তু মালয়েশিয়ায় অসাধ্যটা সাধন হলো কীভাবে? খেলোয়াড়েরাই জানান, এশিয়া কাপের সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার পেস সহায়ক উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা। মেয়েরা সেখানে একটার পর একটা ম্যাচ হারলেও বড় একটা উপকারও হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার গতিময় উইকেটে খেলে আসার পর মালয়েশিয়ায় গিয়ে খেলাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তুলনায় অনেক কম গতিময় মালয়েশিয়ার উইকেট শুরুতেই স্বস্তির একটা হাওয়া বইয়ে দেয় বাংলাদেশ দলে।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে বিসিবিও মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি কিছুটা বাড়তি যত্ন নিতে শুরু করে। মেয়েদের দলের সঙ্গে বিসিবির সাবেক ন্যাশনাল গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার নাজমুল আবেদীনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতের অঞ্জু জৈনকে প্রধান কোচ ও দেবিকা পালশিখরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সহকারী কোচের। ট্রেনার আনোয়ার হোসেন তো ছিলেনই, নতুন যোগ দেন ভারতীয় ফিজিও। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে দলের সঙ্গে নিয়মিত থাকছেন বিসিবির কম্পিউটার বিশ্লেষক শাওন জাহানও।

পালশিখর দলের সঙ্গে যোগ দেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে। এশিয়া কাপে আসেন প্রধান কোচ অঞ্জু জৈন। ভারতীয় মহিলা দলের হয়ে ৮টি টেস্ট আর ৬৫টি ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। পালশিখর খেলেছেন একটি টেস্ট ও ১৫টি ওয়ানডে। এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে দুটি জয়ের রূপকার বলতে পারেন অঞ্জু জৈনকে। ভারতীয় দলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের শক্তি আর দুর্বলতার জায়গাগুলো তাঁর খুব ভালো জানা ছিল। পালশিখরই বলছিলেন, ‘এটা অঞ্জুদির কৃতিত্ব। তিনি মেয়েদের বিশেষ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।’

ভারতের খেলোয়াড়দের কার কোথায় সমস্যা, কাকে কীভাবে আক্রমণ করতে হবে; সালমা-জাহানারাদের সুনির্দিষ্টভাবে সেগুলো বুঝিয়ে দিয়ে ওই দুই ম্যাচের গেম প্ল্যান সাজিয়েছিলেন জৈন। ম্যাচ চলাকালীন ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের তাৎক্ষণিক পরামর্শও দিয়েছেন, ‘ওকে এভাবে খেলো’, ‘একে ওভাবে খেলো না।’ মাঠে কাজে লেগে গেছে সেগুলোই। জৈন অবশ্য পরপর তিনটি সফর থেকে জয় নিয়ে ফেরার কৃতিত্ব দিলেন খেলোয়াড়দের, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে যে ওরা এতটা ভালোভাবে সাড়া দিচ্ছে, সেটাই অসাধারণ।’

অধিনায়ক সালমা খাতুন সবার আগে বললেন বেশি বেশি ম্যাচ খেলার কথা, ‘টানা এতগুলো ম্যাচ খেলার সুযোগ আমরা কমই পাই।’ ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিকতাও তাঁর চোখে ভালো ফলাফলের একটা কারণ। সালমার সতীর্থ রুমানা আহমেদ এসবের সঙ্গে যোগ করেছেন, ‘ফাহিম স্যার এবং নতুন দুই কোচ আমাদের অনেক সাহায্য করছেন। যেকোনো বিষয়েই তারা তাৎক্ষণিক সমাধান দিচ্ছেন।’

এশিয়া কাপের টিম মিটিংয়ে প্রধান কোচের কিছু কথা দলের মধ্যে টনিকের মতো কাজ করেছে। মেয়েদের তিনি বলেছেন, ‘এশিয়া কাপে তোমার উপস্থিতিটা যেন বোঝা যায়। এমন যেন মনে না হয়, তোমরা শুধু খেলার জন্য খেলছ।’ মেয়েরা সেটা দেখিয়ে দেওয়ার পর কোচের নতুন নির্দেশনা-এশিয়া কাপের খেলাটা ধরে রাখতে হবে আয়ারল্যান্ডেও। আর হল্যান্ডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দল এগিয়েছে ম্যাচ ধরে ধরে। এখন তো বিশ্বকাপের জন্যও লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছেন অঞ্জু জৈন, ‘আমরা আর কখনো বাছাইপর্ব খেলে বিশ্বকাপে যেতে চাই না। মেয়েরাও এটাতে বিরক্ত। তারাও চায় বিশ্বকাপে এমন কিছু করতে যেন আর বাছাইপর্ব খেলতে না হয়।’ এই লক্ষ্য পূরণ করতে সুনির্দিষ্টভাবে দুটি জায়গায় দলের উন্নতির প্রয়োজন দেখেন ভারতীয় কোচ-ফিটনেস ও ফিল্ডিং।

অঞ্জু জৈনের আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে আগের এশিয়া কাপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা দলের কোচ ছিলেন সাবেক ইংলিশ অলরাউন্ডার ডেভিড ক্যাপেল। ক্যাপেলের ক্লাস বেশির ভাগ সময়ই হতো একমুখী। তিনি হয়তো বলতেন, ‘এটা করো…ওটা করো’, কিন্তু ক্রিকেটারদের দিক থেকে সাড়া পেতেন কম। ভাষার দূরত্ব ছিল বড় বাধা। অঞ্জু জৈনের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই বললেই চলে। তিনি কিছু বাংলা বোঝেন, হিন্দি সিরিয়াল আর সিনেমা দেখার সুবাদে ক্রিকেটাররাও হিন্দিটা একেবারে খারাপ বোঝেন না। সব মিলিয়ে যোগাযোগটা এখন দ্বিমুখীই হচ্ছে। সালমা-জাহানারারা এখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে কোচের কাছে যাচ্ছেন, সমাধান বুঝে নিচ্ছেন। যেটা আগে কমই হতো।

ভারতীয় দুই কোচ আসার আগে থেকেই মেয়েদের নিয়ে কাজ করছেন নাজমুল আবেদীন। তাঁর চোখে, মেয়েদের ক্রিকেটের উত্থানের প্রধানতম কারণ নিজেদের সামর্থ্য বুঝতে পারা। নাজমুল আবেদীন এর প্রভাব দেখতে শুরু করেন গত মৌসুমের ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটেও মেয়েরা এবার অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টি সিরিজেও দেখেছি, ওরা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করছে।’

এরপর থেকে তো উল্টো তাদের আক্রমণ সামলাতেই ব্যস্ত প্রতিপক্ষ।

সূত্র: প্রথম আলো।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন