মুঠোফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে স্বজনদের বাংলাদেশে ডাকছে রোহিঙ্গারা

 

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

কক্সবাজার, ১৬ অক্টোবর- নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আশা শরণার্থীদের মুঠোফোনের মাধ্যমে মিয়ানমারে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। বেসরকারি সেবামূলক এই সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা শরণার্থীদের ডেরায় ডেরায় গিয়ে এই কর্মসূচি চালাচ্ছে। মিয়ানমারে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ করার সাধ্য নেই তাদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সংস্থাটি।

সোমবার সংস্থাটির কর্মী সুজন বলেন, ‘গত ১০-১৫ দিন যারা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না, বেছে বেছে তাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমরা কোনো টাকা নিচ্ছি না। একেবারে বিনামূল্যে এই সেবা দিচ্ছি।’ তিনি জানান, তাদের এই কর্মসূচির নাম পারিবারিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন (রিস্টোরিং ফ্যামেলি লিংকস)।

এই কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে রেড ক্রিসেন্টের ৪০ জন কর্মী। এরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে উখিয়া-টেকনাফের ১২টি শরণার্থী শিবিরে ঘুরে এ কাজ করছে। এ পর্যন্ত আট থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে।

‘আঁরা এডে ভালা আছি। খাই, লই আছি। ক-ন চিন্তা নাই। তোঁয়ারাও চলি আঁইস্য’। মিয়ানমারে থাকা স্বজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন লালু বেগম। বয়স ৪০ পার হয়েছে আগেই। উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটায় ঠাঁই হয়েছে তার। তার মতো কয়েক হাজার পরিবারের লাখো সদস্য পাহাড়ের গায়ে ঘর বেঁধেছে।

কথা বলার সময় রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীরা রোহিঙ্গাদের কোনো নির্দেশনা দিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে সুজন বলেন, ‘আমরা শুধু তাদের বলে দিচ্ছি, আপনারা কোথায় আছেন এটা বলেন। আপনাদের স্বজনরা যদি বাংলাদেশে আসে কোথাও না গিয়ে আপনারা যেই ক্যাম্পে আছেন সেখানে সোজা আসতে বলেন। যাতে এদিক- সেদিক ছড়িয়ে না পড়ে।’

এর বাইরে শরণার্থীদের যেসব স্বজনরা মিয়ানমারের কারাগারে আছে তাদের কাছেও বার্তা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছে রেড ক্রিসেন্ট। আরপিএম ফরমপূরণ করার মাধ্যমে এই সেবা দিচ্ছে সংস্থাটি। কারাগারে স্বজনরা কেমন আছে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা কোথায় অবস্থা নিয়েছে এসব তথ্যই পাঠানো হচ্ছে ‘রেডক্রস বার্তার’ মাধ্যমে।

তবে মুঠোফোনে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার কর্মসূচিকে একটু আলাদা চোখে দেখছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন, শরণার্থীদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ তারা যখন স্বজনদের ভালো থাকার কথা বলছেন তখন ওই লোকগুলো মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেকে স্বজনকে কাছে পাওয়ার জন্যও এদেশে পারি দিচ্ছে। এখনো বাংলাদেশি সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল। হাজার হাজার মানুষ ঢোকার অপেক্ষায় আছে। তারা যখন জানতে পারছে যে, বাংলাদেশে এলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে তখন তারা নাফ নদী পার হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩৪ ব্যাটেলিয়নে ক্যাপ্টেন রুবেল পাঠানের সঙ্গে। তিনি এ ধরনের কর্মসূচির কথা আগে শোনেননি জানিয়ে বলেন, ‘এটা নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। এ ধরনের কর্মসূচির পেছনে মানবিকবোধ কাজ করলেও, দেশের নিরাপত্তা বিবেচনায় বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এমন অনেক পরিবার আছে যাদের কিছু সদস্য এদেশে চলে এসেছে। কিছু আছে মিয়ানমারে। যারা মিয়ানমারে আছে তারা সুযোগ খুঁজছে বাংলাদেশে আসার। তার মধ্যে যদি তাদের ডেকে আনা হয় তাহলে আরো আগে চলে আসবে।’

শফিউল্লাহ কাটা, বালুখালী ও থ্যাংখালি অস্থায়ী ক্যাম্পের একাধিক শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগের কাছে মুঠোফোন আছে। তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় এসব ফোন সঙ্গে নিয়ে এসেছে। মুঠোফোনে চার্জ দেয়ার জন্য সঙ্গে এনেছে সোলার প্যানেল। সোমবার মিয়ানমার থেকে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের আনজিমানপাড়া সীমান্তে আসা রোহিঙ্গাদের অনেককেই মুঠোফোনে কথা বলতে দেখা গেছে। তারা সীমান্তের বেরিবাঁধে বসে মিয়ানমারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।

মো. রফিক নামে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী তরুণ জানান, তিনি বুচিদং জেলার কোয়েনডাইন গ্রামে থাকা বাবা মো. নবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি মা ও ভাইবোনদের নিয়ে এদেশে এলেও বাবা রয়ে গেছেন মিয়ানমারে। বাবা কেন আসেনি জানতে চাইলে রফিক জানান, তার বাবা মিয়ানমারের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। তাই তিনি আসেননি। তাহলে আপনি কেনো পরিবারের অন্যদের নিয়ে বাংলাদেশে এলেন? জবাবে ওই তরুণ বলেন, তাদের গ্রামে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা অনেকের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। ভয়ে তিনি দেশ ছেড়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘স্বাধীনতাকামী’ সংগঠনগুলোর সদস্যরা খুব করে চাচ্ছেন তাদের দল ভারী করতে। শরণার্থীদের সঙ্গে স্বাধীনতা কার্মী সংগঠনের অনেক কর্মী এদেশে ঢুকে পড়েছে, এমন তথ্য আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে ‘উগ্রবাদীদের’ খুঁজে বের করা কঠিন বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা। তবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের মাধ্যমে শরণার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যে কারণে অপরাধী চক্র এদেশে ঢুকে পড়লেও তাদের কার্যক্রম চালানো সহজ হবে না।

গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। উখিয়ার সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন সোমবার জানান, এ পর্যন্ত কত শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে তার সঠিক পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আনুমানিক সাত লাখ ৪০ হাজার শরণার্থী গত দেড় মাসে এ দেশে ঢুকেছে।

তথ্যসূত্র: ঢাকা টাইমস

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন