মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিরাঙার চিকিৎসা ব্যবস্থা

Untitled-1 copy

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মাত্র  একজন  ডাক্তার দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে ৩১শয্যা বিশিষ্ট মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ফলে ডাক্তার সংকটে নিজেই রোগী হতে চলেছে হাসপাতালটি। কাগজে কলমে ৯ জন ডাক্তারের পদায়ন থাকলেও হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবা চলছে মাত্র একজন ডাক্তার দিয়ে। ফলে পার্বত্য খাগড়াছড়ির জনবহুল বৃহত্তম উপজেলা মাটিরাঙ্গার প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা এখন চরম অনিশ্চিত। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর অবস্থা আরও বেহাল। চিকিৎসক না থাকার কারণে রোগীরাও হাসপাতালে আসা ছেড়ে দিয়েছে। রোগীদের এখন একমাত্র ভরসা নিরাপত্তাবাহিনীর সেবা কেন্দ্রগুলো। ডাক্তার সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় যে কোন সময় মানবিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে বলে চিন্তিত খোদ মাটিরাঙার সচেতন মহলের।

বৃহস্পতিবার মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় উপজেলার দুর্গম জনপদ থেকে অনেক কষ্টে অর্জিত টাকা পয়সা খরচ করে আসা রোগীদের ভীড়। হাসপাতালের সহকারী মেডিকেল অফিসার অংচিংপ্রু চৌধুরী রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারটি জুনিয়র কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসারের দুটি পদই শূন্য। মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী ও এনেসথেসিয়া সর্বোপরি মেডিকেল অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ডাক্তার সংকট থাকায় প্রতিনিয়ত এলাকার গরীব দুস্থ রোগীদের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

হাসপাতালে কর্তব্যরত একমাত্র ডাক্তার ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর,এম,ও) ছাড়া সম্প্রতি ডেপুটেশনে থাকা একজন ডাক্তার ও দুইজন স্বাস্থ্য সহকারীর উপর ভর করেই চলছে উপজেলার স্বাস্থ্য সেবা। এ অবস্থায় তাদের বক্তব্যেও ক্ষোভ ফুটে উঠেছে।

তবে খোঁজ নিযে জানা গেছে, মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খায়রুল আলমের অব্যাহত কর্মস্থলে ও দায়িত্ব পালনে চরম গাফেলতি এ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাঠামোকেও লেজে-গোবরে করে রেখেছে। তিনি কবে আর কখন হাসপাতালে আসেন আর যান তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি হাসপাতালের কর্মরত কেউই।

হাসপাতালের বর্তমান চিকিৎসক সংকটে হতাশা ব্যক্ত করে কর্তব্যরত চিকিৎসক অংচিংপ্রু চৌধুরী বলেন, খুবই সমস্যায় আছি। হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে এখন আমরা যারা আছি তারা পরিবার থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। ইচ্ছা থাকলেও পারিবারিক ও সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারি না। অনেকটা হাফিয়ে উঠেছি বলতে পারেন। তিনি জরুরি ভিত্তিতে শুন্যপদে চিকিৎসক পদায়নে উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

একই অবস্থা চলমান আছে উপজেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও। গুইমারা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ১ জন, আলুটিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ১ জন, বড়নাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ১ জন, তবলছড়ি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ২ জন এবং তবলছড়ির গৌরাঙ্গ পাড়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও সবকটি পদই শুন্য রয়েছে।

মাটিরাঙা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা বেলছড়ির বয়োবৃদ্ধ নীতিশ ত্রিপুরা জানান, হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় রোগীরা এখন আর হাসপাতালে আসেন না। চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষগুলো ভীড় করছে নিরাপত্তাবাহিনীর বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে।

মাটিরাঙ্গা স্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মো. শামছুল হক অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাত্র তিনজন ডাক্তার দিয়ে চলছে মাটিরাঙা উপজেলার স্বাস্থ্য সেবা। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার গাফেলতি আর দায়িত্বে অবহেলার কারণে হাসপাতালটির চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি বলেন, এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত চিকিৎসা সেবার নামে প্রতারিত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় তা বিক্ষোভেও রূপ নিতে পারে। তিনি অবিলম্বে এ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নিয়োগের দাবি জানান।

হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া যায়নি মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. খায়রুল আলমকে। হাসপাতালের এক অফিস স্টাফ জানান, স্যার ঢাকায় এক সেমিনারে যোগ দিতে গেছেন। তবে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মো. শামছুল হকের অভিযোগ, ডা. মো. খায়রুল আলম মাসের বেশির ভাগ সময়ই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।

মাটিরাঙ্গার চিকিৎসক সঙ্কট ও স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা. নীশিত নন্দী মজুমদার বলেন, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু সরকার চিকিৎসক না দিলে আমার কী করার আছে? উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. খায়রুল আলমের ধারাবাহিক কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. নীশিত নন্দী মজুমদার বলেন, তিনি খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দা। তাকে কর্মস্থলে নিয়মিত উপস্থিত থাকার জন্য বহুবার সতর্ক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খায়রুল আলমের সেল ফোনে ফোন দিয়ে এবং ক্ষুদে  বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সব মিলিয়ে এখানকার চিকিৎসা ব্যাবস্থা অনেকটা লেজে-গোবরে অবস্থা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিস্থাপিত ব্যয় বহুল এক্স-রে মেশিনটিও দীর্ঘদিন যাবত অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। জানা গেছে, জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রেডে ভোল্টেজের তারতম্যের কারণে এটি চালু করা যাচ্ছে না। ফলে রোগীদেরকে অতিরিক্ত পয়সা খরচ করে প্রাইভেট ডায়গোনস্টিক সেন্টারে এক্স-রে করতে হয়। কাগজে কলমে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা অনেকটা “কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই” এর মতো অবস্থা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন