মুক্তিযোদ্ধা কবির এর নেই মাথা গোজার ঠাই, ভূমিদস্যুর কবলে ৭৭ একর জমি

চকরিয়া:
দেশ মাতৃকার টানে নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন চট্রগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর কলাউজান গ্রামের মহাজন বাড়ির মৃত জোতিষ দাশের পুত্র দীলিপ কুমার দাশ বর্তমান নাম মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির।

তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তার আরেক ভাই মহাজন বাড়ির আশুতোষ দাশ মহাজন। তারা দু’জনই ছিলেন সংখ্যালঘু হিন্দু জমিদারের সন্তান। যুদ্ধকালীন ১নম্বর সেক্টরে সংশ্লিষ্ট গেরিলা বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার একেএম শামসুল ইসলাম ও কমান্ডার মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করা হুমায়ুন কবির(দীলিপ কুমার)দীর্ঘ ৪৫ বছর পার হলেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম উঠেনি।

তার নিজ নামে-বেনামে রয়েছে প্রচুর ভু-সম্পত্তি। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধাদের বলা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হওয়ার পরও তার প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র সংগ্রহে থাকলেও উত্তর কলাউজান গ্রামে পৈত্রিক ভিটে বাড়িতে তাদের মাথা গোজার ঠাইটুকুও পর্যন্ত নেই। বসতবাড়িসহ প্রায় ৭৭ (সাতাত্তর)একর জায়গা-জমি সবই অন্যের দখলে। মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন তার স্ত্রী ও ৫(পাঁচ)ছেলে-মেয়ে নিয়ে দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে খুঁড়েঘর ভাড়া করে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের মুসলিম পাড়ায় মানবেতর জীবন-যাপন করে আসছে। ছেলে-মেয়েদের মেধা ও প্রতিভা থাকার স্বত্তেও অর্থের অভাবে তারা লেখাপড়া করতে পারছেনা।

জানাগেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির ও তার অপর ভাই আশুতোষ দাশ মহাজনকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল কমরেড সিরাজ সিকদারের পোষ্য বাহিনী ও তার লোকজন। প্রতিনিয়ত সিরাজ সিকদারের লোকজন এলাকায় তাদের নানা ধরণের হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল প্রাণে হত্যা করার। ওই খবরটি যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতে পারে তখনই আত্মরক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধা দু’ভাইকে লাইসেন্সসহ ২টি বন্দুক ও ২টি পাসপোর্ট দেন।

বর্তমানে জাতির পিতার ডকুমেন্ট হিসেবে সেই বন্দুক ও পাসপোর্ট হাতে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের হাতে। যার সিরিয়াল নম্বর-১২১৩ বি,পি,পি-নম্বর ১৩৪ (Section Rule) পাসপোর্ট নম্বর বি ০৮২৯৮।কিছুদিন যেতে না যেতেই ১৯৭৫ সালে ৮মার্চ শনিবার দুপুরে কলাউজান গৌরসু্ন্দর মহাজন বাজারে প্রকাশ্যে দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে নির্মম ভাবে বুলেটের আঘাতে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের ভাই মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ দাশ মহাজনকে।

মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ হত্যার পরই রাষ্ট্রীয় ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাদী হয়ে খুনি আলবদর রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর-৩৯৬ জি.আর-৫৪/৭৫,সিএস-৯২, আইও-এস আই এফ হক,এ এস পি-এস রহমান। ওইদিন রাত্রেই ঘরোয়া ভাবে দলের পার্টির বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে দলের নেতৃবৃন্দদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খাঁন কায়ছার, এম ছিদ্দিক এমপি, ডা. ফয়েজ, আবু ছালেহ এমএনএ, রূপন চৌধুরীরসহ আরো অনেকেই।

এ জঘণ্য ঘটনার পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির ও আশুতোষের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার স্বপরিবারকে ঘাতকেরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ওই মুক্তিযোদ্ধা দু’ভাইয়ের দেশের জন্য নিজেদের সব আত্মত্যাগ ভুলন্ঠিত হয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির(দীলিপ কুমার দাশ)কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছিলাম। যে দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিকে স্বপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে আমার মতো মানুষ কোন কিছুই না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুনে এবং তাকে হারিয়ে শোকাহতবস্থায় আমি যেন জীবনের সব ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।

ওই সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধীরা আমাকে বিভিন্ন ভাবে ঘায়েল করার সুযোগ খুঁজে। যার কারণ হলো আমি সংখ্যালঘু জমিদারের সন্তান ছিলাম। এমতবস্থায় সকলেই আমাকে বিভিন্ন ভাবে ফাঁদে ফেলে আমার থেকে সব সম্পদ লুটের পরিকল্পনা করেন। এ অত্যাচারের নিস্তার হাত থেকে বাঁচতে কোন উপায় না পেয়ে চকরিয়াস্থ হারবাং ইউনিয়নে আমার শ্বশুর বাড়ি এলাকায় এসে নিজেকে আত্মগোপন করি।

তখনকার নোংরা রাজনীতি থেকে বেরিয়ে ধর্মের প্রতি মনোনিবেশ করি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ(স:) জীবনাদর্শে মুগ্ধ হয়ে ১৯৮০ সালে লোহাগাড়াস্থ চুনতির বিখ্যাত বুজর্গ আলেম হাফেজ আহাম্মদ শাহ সাহেব(ব:)নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। তিনি আরো বলেন, ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে কোন আত্মীয় স্বজন তাকে গ্রহণ করেননি। এ সুযোগে পিতার উত্তরাধীকারী সূত্রে পাওয়া জমির উপর জবর-দখল করার কারণে, অনেক দিন দুরত্বের স্বজনহীন ও একাকিত্বের সুযোগে একের পর এক জবর-দখল করে রিক্তহস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুনকে। তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালে ২৪ জানুয়ারি ৩৮৯ কবলামূলে হারবাং মৌজার ৪ একর ৩৫.৫ শতক এবং উত্তর কলাউজান মৌজার প্রায় ২ একর জায়গা তার বড় ভাই রনধীর দাশের নামে রেজিস্ট্রি করে রাখেন শুধু মাত্র স্বাধীনতা স্বপক্ষের সুদিনের আশায়।

পরবর্তীতে ভাই রনধীর মারা গেলে ওই জায়গা মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন নামে বিএস চুড়ান্ত রেকর্ড হলেও আজো ফেরত পাইনি। শুধু মাত্র ধর্মান্তর হওয়ায় জবর-দখল করে রাখেন রনধীরের দু’পুত্র হুমায়ুন ভাতিজা। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরের সরলতার সুযোগে তার ছাত্র হারবাং ইউনিয়নের রোসাঙ্গাপাড়া এলাকার শামসুল ইসলামের পুত্র সাইফুল ইসলাম(টিটু) মাথা গোজার ঠাঁই দেয়ার কথা বলে আশ্রয় নেয়ার আশায় তার নামে ২০১০ সালে ৬ সেপ্টম্বর হারবাং মৌজা এলাকার থেকে বিএস ১৫১৭,১৫১৯ খতিয়ানের ৫২৩২ নম্বর ৫০৫০ নম্বর দুটি কবলামূলে ৮০ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়।

তার গ্রামের স্থানীয় রাজাকার আলবদরদের ভয়ে মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির এলাকা ছাড়েন। তিনি দীর্ঘদিন পরে তাদের ভিটেবাড়ির সন্ধ্যানে নামেন।কিন্তু তেমন কোন ফল হয়নি। সর্বশেষ মাঠ জরিপে ওই যোদ্ধার নামে প্রায় ৭৭ একর জমি রেকর্ড হলেও কলাউজান, হারবাং ও মানিকপুর মৌজাসহ বেশ কিছু এলাকায় কাগজে জমি থাকলেও বর্তমানে ভাড়া কুড়েঘরের মধ্যে দিয়ে অত্যান্ত কষ্টের ভিতর জীবন অতিবাহিত করছে। ছেলের টিউশনি পয়সা দিয়ে চলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন সংসার। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার কাছে তার  দখল হওয়া জায়গা-জমি উদ্ধার এবং মাথা গোজার ঠাঁই করে দেয়ার জন্য নিবেদন মধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন