মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার বৈশ্বিক অভিযোগ, কী করবে চীন?

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

চীন ও রাশিয়া পাশে থাকায়, ভারত নীরবতা অবলম্বন করায় এবং জাতিংঘের দুর্বল অবস্থানের কারণে রোহিঙ্গা জাতিগত নির্মূল অভিযান-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার বেশ স্বস্তি অনুভব করছিল। বাংলাদেশ জাতিসংঘের অকার্যকর কিছু প্রস্তাব পেয়েছিল, মানবাধিকার সংস্থাগুলো সু চির নিন্দায় মুখর ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের জেনারেলরা এসব পাত্তা না দিয়ে পাশে সরিয়ে রাখেন, মিত্ররা তাদের পাশে ছিল। চীনের মধ্যস্ততায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়, তা ছিল ব্যাপকভাবে মিয়ানমারের অনুকূলে। আবার কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় এটি বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি কখনোই।

বাংলাদেশ তার নিজের বাজে প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তার অক্ষমতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এবং জাতিসংঘ ধীরে ধীরে উদ্বাস্তু ঢলের ফলে সৃষ্ট ‘সন্ত্রাসবাদ’ প্রতিরোধ ও দমনের উভয় প্রয়াসেই নিজের অবস্থান জোর দিতে শুরু করে। তাদের ভয়, চীন যদি এই সঙ্কটে বিপুলভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে তবে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে।

সু চির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের গণহত্যার অভিযোগ

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সু চির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার অভিযোগ আনতে যাচ্ছে বলে যে গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেককে, বিশেষ করে চীনকে খুশি করছে না। জেনারেলরা আর কত দিন সু চিকে এবং সেই সুবাদে জেনারেলদের টার্গেট করে চলা বৈশ্বিক প্রচারণা রুখতে পারবেন? এমনকি গণহত্যার অনানুষ্ঠানিক অভিযোগও যদি চলতে থাকে, তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে তা বৈধতা পেয়ে যাবে। ফলে মিয়ানমারের সর্বোত্তম বন্ধুটির পক্ষেও তা অস্বস্তির কারণ হবে।

সু চি সহিংসতা প্রতিরোধ করেছিলেন বলে পাশ্চাত্য মিডিয়া তাকে বড় করে তুলেছিল। কিন্তু তিনি যে সেটার যোগ্য নন, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে তিনি তাদের ব্যর্থ করেছেন, এ কারণেই তার পতন হয়েছে এত গভীর। সম্মানসূচক ডিগ্রি এবং সদস্যপদ প্রত্যাহারে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি এখন পাশ্চাত্যের কারণে ‘অবিশ্বস্ত উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাদের’ প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। অক্সফোর্ড ডিগ্রি তাকে নিরাময় করতে পারেনি।

তবে মিয়ানমার আসলে কখনোই তার নিজের জাহাজের প্রভু ছিল না। অনেক বছর ধরেই চীন এই দেশের শাসকদের পেছনে ছিল, আর তা করেছিল চীনারা তাদের স্বার্থে, মিয়ানমারের স্বার্থে নয়। অচ্ছ্যুৎ মিয়ানমারে কাছ থেকে অন্য যে কারো চেয়ে চীনই বেশি উপকৃত হয়েছে।

এখন কী ওবিওআর আরো সহজে বিক্রি করা যাবে?

ওবিওআর নিয়ে চীন কেবল এই অঞ্চল নয়, এর বাইরেও এগিয়ে যেতে চায়। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বেসামরিক প্রধানবিশিষ্ট সামরিক শাসিত কোনো দেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়াটা এখন চীনের জন্য বিশেষ কোনো সম্পদ নয়। যে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে, সে অনুযায়ী চাপ সৃষ্টি হলে চীন তার উচ্চাভিলাষ কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং চাপ সামাল দিতে পারবে, তা অনিশ্চিত।

মিয়ানমার পরিচালনাকারী ক্ষীণ দৃষ্টির জেনারেলরা রোহিঙ্গা নীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার সময় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এবং জোরালো চীনা সমর্থনের পরিণতি কী হতে পারে, তার হিসাব করতে পারেননি। কিন্তু অতীতের ঘটনাবলীতে দেখা গেছে, জাতি নির্মূল অভিযান একেবারেই সেকেলে কাজ এবং তাতে হিতে বিপরীতই হয়। মিয়ানমারের অবস্থা হলো পুরনো দিনের দেশের মতো। তারা বৈশি^কব্যবস্থা থেকে দীর্ঘ দিন দূরেই ছিল। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে কী হবে?

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ বিশ^ রাজনীতিতে এর গুরুত্ব নেই। কিন্তু গণ-নির্বাসনের কয়েক মাস পর যেমনটা আশা করা হয়েছিল, চেঁচামেচি তেমনভাবে থেমে যায়নি। সমঝোতা স্মারকও কাউকে খুশি করেনি। ফলে উত্তাপ রয়ে গেছে।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সংস্থা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করে এবং সু চির নাম তাতে উত্থাপিত হয়, তবে তা হবে একটি ক্ষতি। আসল প্রশ্ন হলো, তখন চীন কতটুকু পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাবে?

চীনের অগ্রাধিকার কি মিয়ানমারের সাথে খাপ খায়?

রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করার নীতিতে মিয়ানমার তেমনভাবে লাভবান হয়নি। বরং ক্ষতিই হয়েছে। তাদের নামের সাথে এখন ‘বর্ণবাদী ও গণহত্যার’ তকমা লেগে গেছে। এ ধরনের কোনো পরিচিতি তাদের প্রয়োজন ছিল না। এতে দীর্ঘ মেয়াদে তাদের কোনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক কল্যাণ হবে না।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে হয়তো খুবই গরিব ‘অ-নাগরিকদের’ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াটা জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু চীনের স্বার্থ রয়েছে, এমন প্রতিবেশী দেশে বিষয়টি ভালো না-ও লাগতে পারে। চীনের কি কেবল মিয়ানমারেরই প্রয়োজন? যদি তা-ই হয়, তবে খুব ভালো। কিন্তু ওবিওআরের জন্য তার আরো অনেক দেশকে প্রয়োজন। গণহত্যাকারী একটি দেশের সর্বোত্তম বন্ধুর এখন তার ওই আইডিয়াটি বিক্রি করার জন্য অনেক বেশি কূটনীতির প্রয়োজন।

সবশেষে বলা যায়, সু চিকে কলঙ্কিত করার পাশ্চাত্য চাপ হয়তো আরো জোরালো হবে। আর তাতে চীন সম্ভবত নাজুক হয়ে পড়বে। এর ফলে সেক্যুলার ও জিহাদি সন্ত্রাসবাদের উত্থান হতে পারে, সেইসাথে তা পাশ্চাত্যের জন্য সত্যিকারের উদ্বেগজনক বিষয়েও পরিণত হতে পারে।

মাত্র কয়েক মাস আগেও ইন্দো-চীন সঙ্ঘাত বেইজিং অনেক ভালোভাবে সামাল দিয়েছিল। এখন তা কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন। রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে মিয়ানমার হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য উপকৃত হতে পারে, কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতিকে সমর্থন দিয়ে চীন যতটুকু আশঙ্কা করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে পারে।

 

সূত্র: south asian monitor

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন