মিয়ানমারে বিনিয়োগ নিয়ে সমালোচনার জবাব দিল শেভরন

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর অভিযোগ এনেছে – তাদের সাথে অংশীদারিত্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ তেল কোম্পানি শেভরনের যে সমালোচনা হয়েছে, তার জবাব দিয়েছে কোম্পানিটি।

মিয়ানমারে এই কোম্পনিটির শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। গত আগস্ট মাস থেকে দেশটিতে চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে প্রায় ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, বলছে জাতিসংঘ।
গত কয়েক বছর ধরে অন্য বিনিয়োগকারীদের চাপের পর শেভরন বলেছে, তারা এমন একটি বিনিয়োগ

পরিবেশের জন্য কাজ করতে চায় যেখানে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হয়। বিবিসিকে দেয়া এক বিবৃতিতে কোম্পানিটি বলেছে, “মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার মতো জরুরি ব্যাপারটি নিয়ে স্টকহোল্ডারদের সাথে যে সংলাপ চলছে – শেভরন তাকে মূল্য দেয়।”

বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৬ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা “আমরা বিশ্বাস করি যে মার্কিন বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।”

“আমরা অন্য মার্কিন কোম্পানি এবং সরকারের সাথে কাজ করা অব্যাহত রাখবো – যাতে মিয়ানমারে মার্কিন বিনিয়োগের মূল্য এবং মানবাধিকারকে সম্মান করে এমন এক ব্যবসায়িক পরিবেশের প্রসার ঘটানো যায়।”
শেভরন এবং বৃহৎ ফরাসী তেল কোম্পানি টোটালের সম্পদ-সমৃদ্ধ রাখাইন প্রদেশে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান প্রকল্প আছে। তা ছাড়া মিয়ানমারের অন্যান্য এলাকাতেও প্রতিষ্ঠিত প্রকল্প আছে।

সম্প্রতি উত্তর রাখাইন অঞ্চলে মানবাধিকার লংঘন, ধর্ষণ, গণহত্যা এবং গ্রাম ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে। দেশটির নির্বাচিত নেতা অংসান সুচিরও এ জন্য সমালোচনা হয়েছে। মিজ সুচি অক্টোবর মাসে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য একটি জরুরি অর্থনৈতিক কমিটি গঠন করেছেন।

বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যদি মিয়ানমারের প্রধানত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিতজ্বালানি সেক্টরে বিনিয়োগ করতে চায় তাহলে তাদেরকে সেদেশের জাতীয় মিয়ানমা তেল ও গ্যাস এন্টারপ্রাইজ (এম ও জি )-র সাতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে করতে হয়।

শেভরনে বিনিয়োগকারী এবং অধিকারকর্মী জশুয়া ব্রকওয়েল- যিনি আজ্জাদ এ্যাসেট ম্যানেজমেন্টে কাজ করেন – বলছেন এটা এ অঞ্চলে ব্যবসায়িক সম্পদ এবং সুনামের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি হতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ এ দেশ সম্ভবত জাতিগত শুদ্ধি অভিযানে জড়িত।

আজ্জাদ এ্যাসেট ম্যানেজমেন্টই প্রথম বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যারা শেভরনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। তার ঠিক আগেই জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা সেপ্টেমবর মাসে বলেন, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই ঘটছে। আন্তর্জাতিক মনোযোগও তখন এ ঘটনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

এই ফার্মটি শেভরনকে বলেছে যেন তারা সরকারের ওপর ওই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। .আজ্জাদ শেভরনের প্রতি মিয়ানমারে ‘ব্যবসা না করার’ কথা বিবেচনা করতেও আহ্বান জানায়।
মার্কিন এই ফার্মটি ৫ হাজার ৩শ কোটি ডলারের সম্পদ পরিচালনা করে -যার মধ্যে শেভরনের অর্থও রয়েছে।
আজ্জাদ এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট মিয়ানমারে শেভরনের ঐতিহাসিক এবং বর্তমান ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে, বলেন মি. ব্রকওয়েল।

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে গত এক দশকের ও বেশি সময় ধরে লক্ষ লক্ষ লোক পালিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছে।

রাখাইন প্রদেশে দীর্ঘ এবং ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের একটি জঙ্গী প্রতিক্রিয়াকেই আগস্ট মাসের ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়া সহ তাদের বিরুদ্ধে নানা সহিংসতার বিবরণ বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। রাখাইন শরণার্থীদের কাছ থেকে যে ব্যাপক যৌন নির্যাতনের খবর পাওয়া গেছে তার ব্যাপারে জাতিসংঘের সিনিয়র কর্মকর্তা প্রমীলা প্যাটেন বলেন, ধর্ষণ হচ্ছে গণহত্যার একটি অস্ত্র।

চীনেরও রাখাইন প্রদেশে বড় আকারের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে আছে ৭২০ কোটি ডলারের একটি গভীর সমুদ্র বন্দর, এবং গ্যাস পাইপলাইন। ভারতেরও আছে একটি কয়েকশ কোটি ডলারের পরিবহন কাঠামো আছে।

রাখাইন অর্থনৈতিক এলাকা
অক্টোবর মাসে রাখাইন অর্থনৈতিক এলাকার জন্য একটি কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। এতে রাখাইন রাজ্যের কৃষি ও মৎস্যআহরণ শিল্পের উন্নয়নের কথা বলা হয়।

মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচি ভালোভাবেই বোঝেন যে রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে, এবং তিনি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চান-বিবিসিকে একথা বলেন মিয়ানমারের নেত্রীর বিশেষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা শন টাফনেল।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসন – যারা বাংলাদেশে আছে এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে তারাও। তবে অর্থনীতিই সব নয়, একথাও বলেন মি. টাফনেল।
এই কমিটির প্রথম বৈঠকের কয়েকদিনের মধ্যেই মিজ সুচি আগস্ট মাসের পর প্রথমবারের মতো রাখাইন সফর করেন, এবং তার সাথে ছিলেন বড় ব্যবসায়ীরা।

সন্দেহ:
তবে দু পক্ষেই কাজ করছে সন্দেহ।
ফিলিপাইন ভিত্তিক টেনিও ইনটেলিজেন্সের বব হেরেরা-লিম যিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসার ঝুঁকি বিশ্লেষণ করেন- বলেন, এটা কি শুধু লোককে দেখানোর জন্যই করা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। মিয়ানমারের তেল-গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের বড় অংশই আছে এমন জায়গায় যেখানে সহিংসতা চলছে।

তাই এখানে সুশাসন এবং মিয়ানমারের সম্পর্কে বাইরের ধারণা উন্নত হতে হবে। এখন পর্যন্ত আমরা দেখিনি যে বড় কোন বিদেশী বিনিয়োগকারী এখান থেকে চলে যাচ্ছে, বলেন মি হেরেরা-লিম। কিন্তু বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর সম্প্রসারণ এখন ঝিমিয়ে পড়ছে, বলছেন একজন বিনিয়োগকারী।

থুরা কো কোর কোম্পানি ওয়াই জি এ ক্যাপিটাল মিয়ানমারে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। “আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মিয়ানমারের জনসংখ্যা বিপণনের বৃদ্ধি এবং টেলিকম বিপ্লব – এদিক থেকে দেশটির দীর্ঘ মেয়াদি সম্ভাবনা আছে।”

“তবে রাখাইন পরিস্তিতি নিয়ে প্রচুর রাজনৈতিক কথাবার্তা হচ্ছে আমাদের বিনিয়োগকারীরা যে এ ব্যাপারে সচেতন নন তা ভাবা ঠিক হবে না।”

কিছু নতুন গ্যাস অনুসন্ধান প্রকল্প কিছুটা পিছিয়ে গেছে, কিন্তু এর সবটাই হয়তো রাজনৈতিক কারণে নয়। কারণ বৈশ্বিকভাবেই তেল ও গ্যাসের দাম কমে যাওয়ায় পরিস্থিতিটাই এমন।

 

সূত্র: বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন