মন চায় আবার শুক্কুরছড়িতে ফিরে যাই

আ ল ম ফজলুর রহমান

(১৮)

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমি আমার লেখার প্রথম দিকে বলেছিলাম আমি শুক্কুরছড়ি এবং কুসুমছড়ি নিয়ে লিখবো। আজ শক্কুরছড়ি নিয়ে আপনাদের কিছু শুনাবো।

ফারুয়া ব্যাটালিয়ানের নিকট পুর্বের ক্যাম্প হলো শক্কুরছড়ি ক্যাম্প। শুক্কুরছড়ি দুইভাবে যাওয়া যায়। স্পিডবোটে রেংঙ্খিয়াং খাল দিয়ে এবং পায়ে হেঁটে পাহাড়ী পথে। ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা কাপ্তাইতে ব্যাটালিয়ান রিয়ার সদরে বক্স হাউজে এসে উঠেছেন। এই বক্স হাউজগুলো কাপ্তাই লেকের ড্যাম এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্বাইন তৈরির সময় আমেরিকানরা তৈরী করে।

কেন যেন মনে হলো আমি আমার স্ত্রী এবং কন্যাকে কয়েকদিনের জন্য ফারুয়তে নিয়ে আসবো। পাহাড়ের এতো কাছে এসে পাহাড় এবং পাহাড়ের উপজাতি মানুষদের জীবন সম্পর্কে কিছু না জেনে ওরা সমতলে ফিরে যাবে তা কি করে হয়! ওদের আমি স্পিডবোটে করে ফারুয়াতে নিয়ে এলাম। পরে মনে হলো ওদের একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাবো। ঠিক হলো ফারুয়ার সন্নিকটের ক্যাম্প শুক্কুরছড়িতে আমরা একরাত থাকবো। আমরা স্পিডবোটে করে শুক্কুরছড়িতে এলাম। শুক্কুরছড়ির ফরেস্ট ডাকবাংলোতে উঠলাম।

বিকালে ডাকবাংলোতে বসে চা পান এবং পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। লক্ষ্য করলাম, অনেক পোষা হাতি একসাথে পাহাড়ের পাদদেশে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে খাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম একটা হাতি পরে কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এসে তার সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছে এবং এমনভাবে ওকে ডাকছে তার ডাক শুনে আমার দুচোখের পানি গোপন করলাম। এমন মর্মান্তিক সহমর্মিতা আমার জীবনে আর দেখার সৌভাগ্য হবে বলে মনে হয় না। দেখলাম তার সাথী হাতিটা না আসা পর্যন্ত সে একটি গাছের পাতাও ভক্ষণ করলো না। পরে যখন তার সাথী হাতিটা এলো তখনকার দৃশ্য আমি জীবনে ভূলবো না। দুজনে দুজনের সূঁড় পেঁচিয়ে ধরে এমন এক ধরনের গড় গড় আওয়াজ করছিলো মনে হচ্ছিল যেন আমি ” দি রুটস” ছবির দৃশ্যের অভিনয় দেখছি। ঐসময় হাতিগুলোকে আমার স্লেভ ছাড়া কিছু মনে হয়নি।

শুক্কুরছড়ি ক্যাম্প রেংঙ্খিয়াং খালের উত্তর পাড়ে দুই পাহাড়ের মধ্যস্হলের কয়েক কিলোমিটার লম্বা একটি রিইন্ট্রেন্টের শুরুস্হলে অবস্হিত। রিইন্ট্রেন্ট হলো দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলের ডিপ্রেস্ট সমতল ভুমি যা কিলোমিটারের পর কিলোমিটার লম্বা। ক্যাম্প কমান্ডার ব্রিফিং দিলেন এবং বললেন একটি বন্য হাতির পাল এই শুক্কুরছড়ির রিইন্ট্রেন্টে আটকা পড়েছে তাই সবাইকে সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। দেখলাম আমার স্ত্রী বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিলেন।

শুক্কুরছড়ি ক্যাম্পের দক্ষিণে রেংঙ্খিয়াং খাল যেখানে বাঁক নিয়ে উত্তরমূখী হয়েছে ওখানে একটি বোম উপজাতি পাড়া। ঠিক হলো ফিরবার পথে আমরা ঐ গ্রামে যাত্রা বিরতি করবো। রাতে ডিনার শেষে রাত দশটার দিকে ঘুমাতে যাবো- এমন সময় আরম্ভ হলো ঝড়ো বাতাস। মনে হচ্ছিল কাঠের ডাকবাংলো যেন ভেঙ্গে পড়বে। মাঝে মাঝে কাঠের ডাকবাংলো এমন কড় কড় শব্দ করছিলো যেন টিনের ছাদ উড়ে যাবে। এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর চারটার দিকে ঝড় থেমে গেলো।

সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে আমি ক্যাম্প কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে এতো ঝড় হলো কিন্তু কোনো মেঘ এবং বৃষ্টিতো দেখলাম না? উত্তরে ক্যাম্প কমান্ডার জানালো যে শুক্কুরছড়ির রিইন্ট্রেন্ট এই ঝড়ের কারণ। ব্যাখ্যায় সে যা বললো তার সারকথা হলো, শুক্কুরছড়ির এই রিইন্ট্রেন্ট দিনের রোদে উত্তপ্ত হয় ফলে এর বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। উত্তপ্ত রিইন্ট্রেন্ট ঠান্ডা হতে রাত দশটা পর্যন্ত সময় নেয়। রাত দশটা বাজলে ঠান্ডা রিইন্ট্রেন্টে বাইরের বাতাস সজোরে প্রবেশ করতে থাকে ফলে ঝড়ের সৃষ্টি হয় । এটা প্রতিদিনের ঘটনা।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই ঝড়ো বাতাস এতো স্যুদিং এবং ঠান্ডা যে মনে হবে সারা শরীরে যেন একটা শীতল পরশ বয়ে যায়। এখানে গভীর ঘুম হয় । শুক্কুরছিড়র একটা আলাদা বৈশিষ্ট আছে যা এখানে না এলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। শুক্কুরছিড়তে গিয়েছিলাম এক রাতের জন্য। কিন্তু থাকলাম তিন রাত। চতুর্থ দিনে ফিরবার পথে বোম উপজাতি পাড়াতে নামলাম। ওখানের হেডম্যান আমাদের আপ্যায়ন করলেন। আমার স্ত্রী এবং মেয়ে উপজাতি মেয়েদের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। কারণ এর পুর্বে সেনাবাহিনী সদস্যদের পরিবারের কেউ এই গ্রামে আসেন নাই। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম তাহলো, সব মানুষ এক।

পাহাড়ী উপজাতি মেয়ে এবং মহিলা ও আমার স্ত্রী এবং মেয়েকে দেখলাম সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমরা দিনের সবটা সময় এই উপজাতি গ্রামে আনন্দে পার করে বিকালে ফারুয়াতে ফিরে এলাম। আমার ধারণা শুক্কুরছড়িকে আমি যেভাবে ১৯৮২-৮৩ সালে দেখেছি আশা করি সেই শুক্কুরছড়ি সেভাবেই আছে। মন চায় আবার সেখানে ফিরে গিয়ে রাত দশটার ঝড় উপভোগ করি।

চলবে…

♦ জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান- প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “মন চায় আবার শুক্কুরছড়িতে ফিরে যাই”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন