বৌদ্ধরা স্বীকার করল পুলিশের সহায়তায় তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়েছে

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
গত দু সপ্তাহে যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন, তারা এসেছে তিনটি জেলা থেকে: মংডু, বুথিডং, এবং রাথেডং।এ তিনটিই হচ্ছে মায়ানমারের শেষ তিনটি এলাকা যেখানে বড় সংখ্যায় ‘মুক্ত পরিবেশে’ রোহিঙ্গা বসতি আছে।

এ ছাড়া বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গারা আছে শুধু মাত্র বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শিবিরে।এসব জেলায় যাওয়া খুব কঠিন, রাস্তা খারাপ – তা ছাড়া সেখানে যেতে সরকারি অনুমতিপত্র লাগে। আর সাংবাদিকরা এ পারমিট খুব কমই পায়।বিবিসির জোনাথন হেড এক রিপোর্টে লিখছেন, সম্প্রতি তারা ১৮ জন দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের এক দলের অংশ হিসেবে মংডু জেলায় যাবার এক বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন।

এ সফরের একটা সমস্যা হলো, আপনি শুধু সেসব জায়গাই দেখতে পারবেন যেগুলোতে কর্তৃপক্ষ তাদের যেতে দেবে।কিন্তু কখনো কখনো এমন হয় যে এসব বিধিনিষেধের মধ্যেও আপনি অনেক কিছু বুঝে নিতে পারবেন।

তা ছাড়া সরকারের কিছু যুক্তি আছে যা শোনা দরকার। মায়ানমার সরকার এখন একটা বিদ্রোহ পরিস্থিতি মুখোমুখি, তবে অনেকে বলতে পারেন যে তারা নিজেরাই এ সমস্যা তৈরি করেছে। রাখাইন প্রদেশের এই জাতিগত সংঘাতের এক বিরাট ইতিহাস আছে, এবং যে কোনো সরকারের পক্ষেই এটা মোকাবিলা করা কঠিন।

রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়েতে পৌঁছার পর সাংবাদিকদের বলে দেয়া হলো, কেউ গ্রুপ ছেড়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। সন্ধ্যে ৬টা থেকে কারফিউ, তাই এর পর ঘুরে বেড়ানো যাবে না। সাংবাদিকরা যেখানে যেতে চান সেসব অনুরোধ নিরাপত্তার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হলো। হয়তো তারা সত্যি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।

সিটওয়ে থেকে বুথিডং যেতে লাগে ৬ ঘন্টা। সেখান থেকে এক ঘন্টা পাহাড়ি পথ ধরে গেলে পেীঁছবেন মংডু।যারার পথে পড়লো মাইও থু গি গ্রাম। সেখানে প্রথমবারের মতো পুড়িয়ে দেয়া গ্রাম দেখতে পেলাম। এমনকি তালগাছগুলোও পুড়ে গেছে।মায়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য হলো, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে ঢুকে তাদের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত আক্রমণ ও ধবংসযজ্ঞ চলার বর্ণনা দিচ্ছে, সেই নেতিবাচক প্রচারের একটা জবাব দেয়া।কিন্তু এসব প্রয়াস ভালোভাবে কাজ করছে না।

বিবিসির জোনাথন হেড বলছেন, ‘আমাদের প্রথম নেয়া হলো মংডুর একটি ছোট স্কুলে, এখানে আশ্রয় নিয়েছে ঘরবাড়ি হারানো হিন্দু পরিবার। সবাই বলছে একই গল্প- তাদের ওপর মুসলিমদের আক্রমণ, এবং তার পর ভয়ে পালানোর কাহিনি’।

কিন্তু বিবিসি পরে চিনতে পেরেছে যে ওপরের ছবির মহিলাটি একটি হিন্দু গ্রাম থেকে আসা।‘কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যে হিন্দুরা বাংলাদেশে পালিয়েছে তারা সবাই বলছে, তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে রাখাইন বৌদ্ধরা, কারণ তারা দেখতে রোহিঙ্গাদেরই মতো’।‘এই স্কুলে আমাদের সাথে ছিল সশস্ত্র পুলিশ ও কর্মকর্তারা । তারা কি মুক্তভাবে কথা বলতে পারছিল?’

‘একজন লোক বলতে শুরু করলো কিভাবে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামের ওপর গুলি করলো। কিন্তু খুব দ্রুত একজন প্রতিবেশী তার কথা সংশোধন করে দিল’।‘কমলা রঙের ব্লাউজ এবং ধূসর-বেগুনি লুঙ্গি পরা এক মহিলা উত্তেজিতভাবে মুসলিমদের আক্রমণের কথা বলতে লাগলো’।

কর্নেল ফোনে টিন্ট – তিনি বলছেন সব গ্রামেই আগুন দিয়েছে মুসলিমরা।‘এর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি বৌদ্ধ মন্দিরে। সেখানে একজন ভিক্ষু বর্ণনা করলেন, কিভাবে মুসলিমরা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। অগ্নিসংযোগের ছবিও আমাদের দেখানো হলো। ছবিগুলো অদ্ভূত’।

‘হাজিদের সাদা টুপি পরা কিছু লোক একটি ঘরের পাতার তৈরি চালায় আগুন দিচ্ছে। মহিলাদের দেখা যাচ্ছে – তারা নাটকীয় ভঙ্গিতে তলোয়ার এবং দা ঘোরাচ্ছে, তাদের মাথায় টেবিলক্লথের মতো লেসের কাজ করা কাপড়’।‘এর পর আমি দেখলাম, এই মহিলাদের একজন হচ্ছে স্কুলের সেই হিন্দু মহিলাটি – যে উত্তেজিতভাবে নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিল।

আর এই ঘর পোড়ানো পুরুষদের মধ্যে একজনকে আমি সেই বাস্তুচ্যুত হিন্দুদের মধ্যে দেখেছি’।‘তার মানে, তারা এমনভাবে কিছু ভুয়া ছবি তুলেছে, যাতে মনে হয় মুসলিমরা ঘনবাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে’।

বিবিসির জনাথন হেড বলছেন, তাদের আরো কথা হয় কর্ণেল ফোনে টিন্ট-এর সাথে। তিনি হচ্ছেন স্থানীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী্ ।

একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বলছেন, মুসলিমরা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।তিনি বর্ণনা করলেন, কিভাবে বাঙালি সন্ত্রাসীরা (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিরদের তারা এভাবেই বর্ণনা করে) রোহিঙ্গা গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, এবং গ্রামের লোকদের চাপ দিয়েছে যেন প্রতি বাড়ি থেকে যোদ্ধা হিসেবে একজন লোক দেয়া হয়। যারা একথা মানছে না তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

এই কর্নেল আরো অভিযোগ করলেন, জঙ্গীরা মাইন পাতছে এবং তিনটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।জোনাথন হেড তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে তিনি কি এটাই বলতে চাচ্ছেন যে – এই যে এতসব গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে – এগুলো জঙ্গীরাই করছে?তিনি নিশ্চিত করলেন যে এটাই সরকারের বক্তব্য। সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘এর প্রমাণ কোথায়? যেসব মহিলারা এ দাবি করছে, আপনি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। এদেরকে কি কেউ ধর্ষণ করতে চাইবে?’

মংডুতে যে মুসলিমদের সাথে আমরা কথা বলতে পেরেছি, তারা ক্যামেরার সামনে কথা বলার সাহস করতে পারে নি। আমাদের পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে এদের দু’একজনের সাথে কথা বললাম। তারা বললো, নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে গ্রাম ছাড়তে দিচ্ছে না। তারা খাদ্যাভাব এবং তীব্র আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

একজন যুবক বলছিল, তারা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে চায়, কিন্তু তাদের নেতারা কর্তৃপক্ষের সাথে এক চুক্তি করেছে যাতে তারা চলে যেতে না পারে। এখানকার বাঙালি বাজার এখন নিরব। এজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কিসের ভয় করছেন। ‘সরকার’ – তার জবাব।

আমাদের প্রধান গন্তব্য ছিল মংডুর বাইরে আলেল থান কিয়াও – একটি সমুদ্র তীরবর্তী শহর। এখানে আরসা জঙ্গীরা আক্রমণ চালায় ২৫শে আগস্ট ভোরে। যাবার পথে আমরা দেখলাম একে পর এক গ্রাম – সবগুলোই একেবারেই জনশূন্য। দেখলাম, নৌকা, গরু-ছাগল ফেলে লোকে চলে গেছে।

কোথায় কোন মানুষ চোখে পড়ল না।শহরটিকে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা ক্লিনিক দেখলাম, মেদসাঁ সঁ ফঁতিয়ের সা্ইনবোর্ড লাগানো, সেটাও পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে।

দূরে আমরা দেখলাম চারটি জায়গা থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলি আকাশে উঠছে। থেকে থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা অনুমান করলাম, আরো কিছু গ্রামে আগুন লাগানো হচ্ছে।পুলিশ লেফটেন্যান্ট আউং কিয়াং মো বর্ণনা করলেন – কিভাবে তাকে আক্রমণের আগাম সতর্কবাণী দেয়া হয়েছিল।

তিনি অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষার জন্য ব্যারাকে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিলেন, এবং ‘বন্দুক, তলোয়ার ও ঘরে-তৈরি বিস্ফোরক নিয়ে আসা’ আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তার লোকেরা কিভাবে লড়াই করেছে এবং তাড়িয়ে দিয়েছে, তাও বললেন।

এ লড়াইয়ে ১৭ জন জঙ্গী এবং একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা নিহত হয়। এর কিছু পরই মুসলিম জনগোষ্ঠী পালিয়ে যায়।কিন্তুওই আক্রমণের দু সপ্তাহ পরেও এবং বৃষ্টির মধ্যেও এই শহরের কিছু অংশে এখনো আগুন জ্বলছে কেন – এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়ছিলেন।

তিনি ইতস্তত করে বললেন, হয়তো কিছু মুসলিম এখনো রয়ে গেছে, এবং চলে যাবার আগে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে গেছে।তবে আলেল থান কিয়াও শহর থেকে ফেরার পথে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যার জন্য কেউ তৈরি ছিল না।

আমরা দেখলাম, রাস্তার পাশেই ধানক্ষেতের ওপারে গাছের ভেতর থেকে ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে আকাশে উঠছে। বোঝাই যায়, আগুনটা লেগেছে এই মাত্র। আমরা চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বললাম। গাড়ি থামলো। আমরা আমাদের সরকারি সঙ্গীকে ফেলেই দৌড়াতে শুরু করলাম।

পুলিশ আমাদের সাথে এলো। কিন্তু তারা বললো গ্রামের ভেতরে যাওয়াটা নিরাপদ হবে না। আমরা তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম।আগুনে বাড়িঘর পোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি চারদিকে। মাটিতে ছড়িয়ে আছে কাপড় -বোঝাই যায় মুসলিম মহিলাদের কাপড়।

দেখলাম কয়েকজন পেশীবহুল দেহের যুবক, তাদের হাতে তলোয়ার এবং দা, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ১৮ জন সাংবাদিককে তাদের দিকে দৌড়ে আসতে দেখে তারা একটু বিভ্রান্ত হলো। তারা চেষ্টা করলো যাতে আমরা তাদের ভিডিও করতে না পারি।

দুজন দৌড়ে গ্রামের আরো ভেতর দিকে চলে গেল, তাদের আরেকজন লোককে বের করে নিয়ে এলো এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।তারা বললো, তারা রাখাইন বৌদ্ধ। আমাদের একজন সহযোগী তাদের একজনের সাথে অল্প একটু সময় কথা বললো। তারা স্বীকার করলো, তারা পুলিশের সাহায্য নিয়েই তারা বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়েছে।

আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, একটা মাদ্রাসা- যার ছাদে এই মাত্র আগুন লাগানো হয়েছে। আরবিতে লেখা বইপত্র বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। একটা প্লাস্টিকে জগ- তার থেকে পেট্রোলের গন্ধ বেরুচ্ছে, পড়ে আছে রাস্তার ওপর। গ্রামটির নাম হচ্ছে গাওদু থার ইয়া। এটা একটা মুসলিম গ্রাম ছিল।

গ্রামের বাসিন্দাদের কোথাও দেখলাম না।যে রাখাইন লোকেরা আগুন লাগিয়েছিল – তাদের দেখলাম ঘরগুলো থেকে লুট করা নানা জিনিস নিয়ে আমাদের সাথে থাকা পুলিশের গাড়ির সামনে দিয়েই চলে গেল।এখানকার কাছেই বড় পুলিশ ব্যারাক আছে। তবে আগুন লাগানো ঠেকাতে কেউ কোনো চেষ্টা করে নি।
সূত্র; বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন