বৃষ্টিতে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুদের কান্না

নিশাত সুলতানা:

এ বছরের বৃষ্টি যেন কিছুতেই মানতে চাইছে না বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্যের স্বাভাবিক নিয়ম। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্তকালজুড়ে প্রায় সারা বছর কেমন যেন বর্ষার আমেজেই কেটে গেল। আসন্ন শীত কি তার স্বমূর্তিতে আসবে, নাকি শীতল বর্ষার রূপ নিয়ে আসবে, তা হয়তো আবহাওয়াবিদেরা বলতে পারবেন।

তবে কোনো বিশ্লেষণ ছাড়াই জানি, এ বৃষ্টি বুঝতে চাইছে না হতভাগ্য মানুষের দুর্দশাটা। আসন্ন শীত কোনোভাবেই ভাগ্যের পরিবর্তন আনবে না রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মানুষগুলোর মানবেতর জীবনযাপনে। তাদের জীবনযুদ্ধ কঠিন থেকে আরও কঠিনতর হবে সামনের হাড়কাঁপানো শীতের দিনগুলোয়। আর এর সঙ্গে বৃষ্টি যদি তার বর্তমান রূপ ধরে রাখে, তাহলে তো কথাই নেই।

বৃষ্টিমুখর রাতে আমার শিশুটি যখন নিশ্চিন্ত মনে আমার শরীরে তার হাত রেখে ঘুমায়, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিকষ কালো অন্ধকারে পাহাড়ের গায়ে পলিথিনঘেরা ছোট্ট ঘরের ক্রন্দনরত শিশুটির মুখ। ওদের কারও কারও হয়তো মা-বাবা আছে, আবার কেউবা হয়তো সব হারিয়েছে। আমি আমার শিশুটিকে যখন কম্বল দিয়ে ঢেকে দিই, তখন কোনো অসহায় রোহিঙ্গা মা হয়তো তার শরীরের সমস্ত ওম দিয়েও পারেন না নিজের শিশুটিকে বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা করতে। কোনো মা হয়তো প্রসববেদনায় ছটফট করেন। কে দেবে নিরাপত্তা এই মাকে কিংবা তার অনাগত সন্তানকে!

ইদানীং বৃষ্টিমুখর দিনগুলোয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যখন অনেকেই বৃষ্টিবিলাসের কথা বলেন, তখন আমার চোখে কেবলই ভাসতে থাকে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা নিষ্পাপ রোহিঙ্গা শিশুগুলোর বৃষ্টিভেজা মুখ। খিচুড়ি-ইলিশের ছবি, বৃষ্টির কাব্য কিংবা বৃষ্টিস্নাত লংড্রাইভের দৃশ্যের পাশে কঠিন বাস্তবতা হয়ে মনের গভীরে ধরা দেয় রোজ সকালে অফিসের প্রবেশপথের ব্যানারে জীবন্ত হয়ে ওঠা নিষ্পাপ রোহিঙ্গা শিশুদের সকরুণ চাহনি। কী মায়া ওদের চোখে! কী গভীর সে চাহনি! সে চাহনি একমুহূর্তেই মানবতার ভিত্তি কাঁপিয়ে দেওয়ায় ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তাদের এই নিষ্পাপ কোমল চোখের ভয়ার্ত করুণ চাহনি কিছুতেই মন গলাতে পারে না তথাকথিত বিশ্বনেতাদের। ধিক এ মানবতা, ধিক এ বিশ্বরাজনীতি!

দেশে দেশে, যুগে যুগে যেকোনো যুদ্ধে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশুরা। এ নিয়ে বিশ্ব দরবারে বড় বড় সম্মেলন হয়, বড় বড় বুলি উচ্চারিত হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে, জনসমাবেশ কিংবা মানববন্ধন হয়, আবার একসময় এসব থেমেও যায়। আবার এই অস্থিতিশীলতার ডামাডোলে অনেকের বড় বাণিজ্য হয়, কেউ কেউ আদায় করেন নানা পদক কিংবা পুরস্কার। কিন্তু কিছু কি বদলায়? ব্যক্তিগত, গাষ্ঠীগত কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে বদলায় না যুদ্ধজয়ের নিকৃষ্ট এই রীতির।

২০১৫ সালে সিরিয়ান রিফিউজি শিশু আইলানের নিথর মৃতদেহ জীবন্ত হয়ে সে সময় হয়তো কিছুটা নাড়া দিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। কিন্তু বিবেক কেন জানি না বারবারই ঘুমিয়ে পড়তে ভালোবাসে। বাংলাদেশে প্রবেশকালে যখন প্রতিদিন অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশুর সলিলসমাধি হয় নাফ নদীতে, তখন কেন যেন তা আমাদের বিবেকে তেমন কোনো দাগ আর কাটে না। আমরা যেন অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি নিয়মিত তাদের মৃত্যুসংবাদ পেতে পেতে।

ফিলিস্তিনের শিশুরা কাঁদছে প্রতিনিয়ত, কাঁদছে রোহিঙ্গা শিশুরা, কাঁদছে ইয়েমেনের শিশুরা। অস্থিতিশীল বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের শিশুর কান্নায় সিক্ত এ সময়ের ইতিহাস। এই কান্না কিন্তু নিছক কান্না নয়, এই কান্না মানবতার কান্না। বিশ্বনেতারা কি সেই কান্না শোনেন না! প্রায়ই মনে হয়, আমরা কী জবাব দেব এই শিশুগুলোকে! এই শিশুগুলোর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য আমরা কাকে দোষ দেব? জানি, শেষ পর্যন্ত সব দোষ ওদের ভাগ্যের ওপরই পড়বে, যে ভাগ্য গড়ার পেছনে তাদের ন্যূনতম ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু তারপরও ওদের ভাগ্যের দায় ওদেরকেই নিতে হবে, চালিয়ে যেতে হবে জীবনযুদ্ধ।

শিশুদের এই কান্না, এই আকুতি জানি মন গলাতে পারবে না শান্তির পদকধারী কিংবা পদকবিহীন বড় বড় বিশ্বনেতার। কিন্তু প্রকৃতির কাছে দাবি জানাই, তুমি অন্তত একটু দয়া করো রোহিঙ্গা শিশুদের। এবার থামাও তোমার বৃষ্টির রথ। একবার চেয়ে দেখো নিষ্পাপ শিশুদের মুখের দিকে। নাকি তুমি ওদের চোখের কান্নার ধারাকে বৃষ্টির ধারা ভেবে ভুল করছ?

 

সূত্র: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন