বিদ্যানন্দর ম্রো ভাষার প্রথম বই

সঞ্চয় ঘোষ

ভাবলে কেমন লাগে- আজ বা কালের মধ্যেই হয়তো কোনো একটা ভাষা পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। যে ভাষায় একদিন কথা বলত একটা সমগ্র গোষ্ঠী। তাকে কেন্দ্র করে হয়তো গড়ে উঠেছিল একটি স্বতন্ত্র সমাজ। একটি ভাষা যখন হারিয়ে যায়, এসব কিছু নিয়েই সে হারিয়ে যায়। তাই ভাষা শুধু মুখের কথা নয়। একটি ভাষাভাষী মানব সমাজের অস্তিত্বও বহন করে। একেকটি ভাষা নিজেই তার ব্যবহারকারীর ইতিহাস বহন করে থাকে।

এক হিসাব মতে, প্রতি ১৪ দিনে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। অর্থাৎ চলতি বছরেই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে অন্তত ২৬টি ভাষা। ধীরে ধীরে অস্তিত্বের শঙ্কায় পড়া এসব ভাষার শব্দভাণ্ডারের প্রয়োজন ফুরাবে। কথা বলার কেউ থাকবে না। হবে না কখনও আর কবিতা বা গান লেখা। তবে হারিয়ে যেতে বসা এমনই অনেক ভাষাকে রক্ষা করার লক্ষ্যে মানুষ এখন কাজ করছে। লিখে রাখছে, বই প্রকাশ করছে, চালিয়ে যাচ্ছে নানান গবেষণা। ভাষা রক্ষার ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বাড়ছে দিন দিন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রক্ষার এমনই গৌরবোজ্জ্বল ঘটনার দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে আজ মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার নতুন দিন সূচিত হয়ে চলেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশে এবার একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে বিদ্যানন্দ নামের একটি নতুন প্রকাশনী ম্রো ভাষায় লেখা গল্পের বই প্রকাশ করেছে এবং ম্রো ভাষাভাষী মানুষদের হাতে বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়েছে সে বই।

ম্রো বা মুরং নৃ-গোষ্ঠীর জনজীবনে প্রচলিত বিশ্বাস, রূপকথা, রীতিনীতি- এসব নিয়েই লেখা হয়েছে গল্পের বই ‘ম্রো রূপকথা’। দেশের অন্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীরাও যাতে পড়তে পারে, সে জন্য বইটিতে স্থান পাওয়া গল্পগুলোকে ম্রো ভাষার পাশাপাশি ছাপানো হয়েছে বাংলাতেও। দ্বিভাষিক এ বইটি লিখেছেন মুরং সম্প্রদায়েরই একজন লেখক ইয়াংঙান ম্রো। এটিই ম্রো ভাষার নিজস্ব বর্ণমালায় প্রকাশিত প্রথম কোনো গল্পের বই। ম্রো ভাষায় এর আগেও বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেগুলো প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের বই।

বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা রয়েছে। ম্রো জনগোষ্ঠী বসবাস করে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায়। ১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ২২ হাজার ১৭৮। তাদের ভাষা তিব্বতি-বর্মি ভাষা পরিবারের কুকি-চীন গোত্রভুক্ত।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি, বিশেষ করে চরম দরিদ্র, গৃহহীন ও অনাথ শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি ও আশ্রয় দিয়ে তাদের জাতির সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে। বিদ্যানন্দ প্রকাশনীটিও সে ফাউন্ডেশনেরই একটি সংযোজন। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ছিল সে প্রকাশনীর বইয়ের দোকান।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একাধিক উপজাতি অনাথ আশ্রমে কয়েকশ’ শিশু থাকে। তাদের মাতৃভাষার বই উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা থেকেই ম্রো ভাষার বইটির প্রকাশনা। তবে ম্রো ভাষার লেখক খুঁজে বের করাও একটি কঠিন কাজ ছিল তাদের জন্য। আর একটা সমস্যা ছিল, সে ভাষার বর্ণমালার ফন্ট বা মুদ্রা। দেশের সবচেয়ে বড় পুস্তক প্রকাশ কেন্দ্র বাংলাবাজারে ম্রো ভাষার বর্ণমালার এসব ফন্টে কাজ হয়নি কোনো দিন। তবু সব বাধা পেরিয়ে ছয় মাসের পরিশ্রমে প্রকাশ পেয়েছে প্রথম ম্রো রূপকথার এ বইটি; যার মাধ্যমে ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তাদের মাতৃভাষা চর্চার লিখিত রূপটি বেগবান হবে বলে মনে করা যায়।

পাহাড়ি এলাকার অনেক ভাষা সংরক্ষণে মূল সমস্যা হচ্ছে, এগুলো কেবল কথ্য ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। লেখার সময় এরা বাংলা বর্ণেই লেখে। তবে বেশ কিছু আগ্রহী উপজাতি তরুণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা ও ফন্টকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটও দেশের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে নিয়মিত কাজ করে। সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি বিদ্যানন্দের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন উদ্যোগ সংকটাপন্ন ভাষাগুলোকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন