বান্দরবানের ক্রাইক্ষ্যং-হাংসামাপাড়ার বিজিবি সেক্টর নির্মাণের প্রকল্প কাজ স্থগিত রাখার আহ্বান জানালেন সৈয়দ আবুল মকসুদ

image_144588

স্টাফ রিপোর্টার:

বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, দেশের সকল ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর উপর যে অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম হচ্ছে তার জবাবদিহিতা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান এবং সংবিধান অনুসারে তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। এছাড়া তিনি সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত ৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন দরকার বলে উল্লেখ করেন। তিনি এ বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত অমীমাংসিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত বান্দরবানের ক্রাইক্ষ্যং-হাংসামাপাড়ার বিজিবি সেক্টর নির্মাণের প্রকল্প কাজ স্থগিত রাখার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।

বান্দরবানের ক্রাইক্ষ্যং-হাংসামাপাড়ার বিজিবি সেক্টর নির্মাণের প্রকল্প কাজ স্থগিত করার দাবিতে আজ ২৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১১টায় বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষং-হাংসামাপাড়া এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য পাহাড়ীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল এবং স্থাপনা নির্মাণের নামে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের অপকৌশল ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দল এর উদ্যোগে এক সংবাদ সম্মেলন সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির গোল টেবিল কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপজাতি সংগঠক দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট নীলুফার বানু, চলচ্চিত্র নির্মাতা রাশেদ রাইন ও কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রমুখ। সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দলের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব মীর।

সম্মেলনে জিয়াউদ্দিন তারিক আলি বলেন, ‘শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন খাস জমি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের সামরিক শাসন চলছে যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তিনি জাতীয় সংসদে বিজিবির ক্যাম্প স্থাপনের জন্যে অবৈধভাবে ভূমি গ্রহণের বিষয়টি উত্থাপন হওয়া দরকার বলে মনে করেন’।

রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘এখনো তিন পার্বত্য জেলায় সামরিক শাসন বহাল রয়েছে। তিন জেলায় ৬টি ক্যাম্প। রাষ্ট্র আদিবাসীদের পর মনে করে। আর বাঙালীদের আপন মনে করে সেখানে তাদের বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে বোঝা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করার চক্রান্ত চলছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ধারা না মেনে রাজা, হেডম্যান, কার্ব্বারীদের সাথে আলোচনা না করে ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। সামরিক শাসনে গণতন্ত্রে মুক্ত চিন্তার বিকাশ হয় না। তাই যে কোন মূল্যে আদিবাসীদের অধিকার, ভূমি রক্ষা করতে হবে বলে তিনি সবার কাছে আহ্বান জানান’।

উল্লেখ্য স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল গত ২০ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জনাব জিয়া উদ্দিন তারিক আলি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব রাজীব মীর, কাপেং ফাউন্ডেশনের দীপায়ন খীসা, দেশ টিভির সাংবাদিক নজরুল কবির, একাত্তর টিভির সাংবাদিক নয়ন আদিত্য, ডেইলী স্টারের তামান্না রহমান, সাহাদাত হোসেন, প্রথম আলোর প্রণব বল, কালের কন্ঠের বিপ্লব রহমান, বাংলা নিউজ ২৪ এর নাজমুল হক, বিডি নিউজ ২৪ এর সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম এবং ঢাকা ট্রিবিউনের আবিদ আজাদ।

লিখিত বক্তব্যে রাজীব মীর উল্লেখ করেন, “একটা বিশাল এলাকা কোনও পূর্ব ঘোষণা ছাড়া কাঁটা তারের বেড়া দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর আদিবাসী জনগণ ভূমি দখলদারদের কাছে সবকিছু হারিয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব। সম্প্রতি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষং-হাংসামাপাড়া এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য আদিবাসীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল এবং স্থাপনা নির্মাণ নতুন সংযোজন মাত্র। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বা জনগন কারও সাথে আলোচনা ব্যতিরেকে এ ধরণের দখল কার্যক্রম তাই প্রশ্নবিদ্ধ। এতে পাড়াবাসির উচ্ছেদের ভয় তো আছেই সাথে এ অঞ্চলের জনমিতিক বিন্যাসও নষ্ট হবে’।

উল্লেখ্য বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষং-হাংসামাপাড়া এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য পাহাড়ীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল এবং স্থাপনা নির্মাণের নামে পাহাড়িদের ভুমি থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ এনে সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি দল গত ২০ আক্টোবর ২০১৪ তারিখে ঘটনাস্থলে যান।

তৎকালীন জেলা প্রশাসকের মৌখিক নির্দেশে পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর আইন অনুযায়ী পাড়াবাসির ২৫ পরিবারের বসত ভিটার জন্য ৩০ শতক করে মোট ৭.৫০ একর জমি ১৯৯৩ সালে মৌজার হেডম্যান কর্তৃক দেওয়া বন্দোবস্ত দলিলও রয়েছে।
প্রসঙ্গত বান্দরবান সদর উপজেলার হ্লাপাই মৌজার মোট ৭০০০ সাত হাজার একর জমি থেকে বন বিভাগের দখলে আছে ৪৫৫০ চার হাজার পাঁচশত পঞ্চাশ একর ,অব্যবহৃত খাল ঝিরি প্রায় ১০০০ এক হাজার একর আর ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় ১০০০ এক হাজার একর । উক্ত মৌজায় আট শতাধিক পরিবার জুমের জমির অভাবে চরম দারিদ্রতায় জীবন অতিবাহিত করছে। এমতাবস্থায় বন বিভাগ থেকেও তো জমি নেয়া যেত কিন্তু তা না করে ক্রাইক্ষং-হাংসামাপাড়া এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য জমি অধিগ্রহন করার প্রক্রিয়ায় আগেই জায়গা দখলের মানসিকতা বোধগম্য নয় । এটি হলে স্থানীয় আদিবাসীগণ নিশ্চিতভাবে উচ্ছেদের সম্মূখীন হবেন বলে আমাদের প্রতীতি হয় ।

উল্লেখ্য, বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য তারাছা মৌজার ছাইঙ্গা ব্রিকফিল্ডকে নির্ধারণ করা হয় । পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈচিং ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্ধারিত জায়গাটিও ব্রিকফিল্ডের মালিক ও দুইটি পরিবারের একটি মামুলি আপত্তি দরখাস্তের অজুহাতে বাতিল করা হয় । এরপর রামজাদী বিহার এলাকা দখলের চেষ্টাও প্রতিহত হওয়ায় বর্তমানে ক্রাইক্ষং-হাংসামাপাড়া এলাকার জমি থেকে পাহাড়দের ন্যায্যতা অস্বীকারের মধ্য দিয়ে জমি, শ্মশান, বাগান সব দখল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে”।
তিনি আরো বলেন, “আমরা উক্ত স্থান পরিদর্শন শেষে শুনতে পাই আমরা বান্দরবান শহরে যেখানে উঠেছি সেখানে অনেকেই আমাদের খুঁজছেন। খবর পাই সম অধিকার আমাদের রাস্তা আটকে দিয়েছে,ফিরবার পথে আক্রমণ হতে পারে। অবাক হই, কারণ আমরা কারও বিরুদ্ধে যাই নি। যেখানে গিয়েছি সেটা বিজিবি দখল করেছে কিন্তু সম অধিকার কেন আমাদের পথ আটকাবে,আক্রমণ করবে। অবশেষে পুলিশ প্রহরায় আমরা শহরে আসি কিন্তু বিজিবির দখল আর সমঅধিকারের ক্ষেপে যাওয়া মিলছিলো না” ।

তিনি বলেন-আমরা নিম্নোক্ত বিষয়াবলী লক্ষ্য করেছি যে, “এক. আদিবাসী জমি অধিগ্রহণের কোনও ক্ষেত্রেই রাজার কোনও অবস্থান নেই । রাজাকে অধিগ্রহণ বিষয়ক কোনও কমিটিতে রাখা হয় না ,কাজেই তাঁর ভুমিকা অনুল্লেখ্য । শাসন যেহেতু বিলুপ্ত হয় নাই এবং ১৯৯৭ সালের স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেও ভূমি ব্যবস্থাপনায় প্রথাগত অইন ,রীতি ও পদ্ধতিকে গ্রাহ্য করা হয়েছে। সেই হেতু ভূমি অধিগ্রহণ কিংবা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে রাজার ভুমিকা অগ্রাহ্য করবার কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না
দুই. যে কোনও অধিগ্রহণে হেডম্যানের সুপারিশ প্রয়োজন হয় । হেডম্যানকে ভুলিয়ে বা প্রতারণা করে কোন ব্যক্তি সুপারিশ নিলেও নিতে পারে কিন্তু বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য হেডম্যান এর সুপারিশ ছাড়া জমি দখল কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয় ।
তিন. পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে খাস জমি বলতে কিছু নাই । জমির মালিকানা সত্ব মৌাজা হ্যাডম্যানের কাছে কিংবা সরাসরি সার্কেল চীফ এর হাতে ন্যস্ত থাকে। কাজেই খাস জমি ধারণা থেকে দরিদ্র আদিবাসীদের জায়গাজমি অধিগ্রহণ খুবই প্রশ্নবিদ্ধ ।
চার. উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাস ও বিজিবি ক্যাম্প ব্যতীত সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর অন্যান্য অস্থায়ী ক্যাম্প সরিয়ে নেবার কথা থাকায় বিষয়টি চুক্তি পরিপন্থী। নানা প্রক্রিয়ায় এসকল জমি দখলের কাজ এগুচ্ছে যা পাহাড়ের সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
পাঁচ. আগে বাঙ্গালি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে জমি দখল করার অভিযোগ উঠলেও এখন সরাসরি প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত বাহিনীকে এরকম অধিগ্রহণে উৎসাহিত করা আশাব্যঞ্জক নয় ।
ছয. জাতীয় আইনে কোন নাগরিককে স্বীয় ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা অন্যায় এবং আন্তর্জাতিক আইনে কোন ব্যক্তি বা সমষ্টিকে তাদের মুক্ত, অবহিত ও পূর্ব সম্মতিব্যতিরেকে কোন ভুমি থেকে উচ্ছেদকরণ অবৈধ ।
আমরা তাই দরিদ্র আদিবাসীদের ভুমি রক্ষায় বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষং-হাংসামাপাড়া এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য আদিবাসীদের জমি ও শ্মশানভূমি দখল এবং স্থাপনা নির্মাণ কাজ বন্ধ করবার আহবান জানাচ্ছি এবং এখানে কোনও অধিগ্রহণ যাতে না হয় সে বিষয়টিও নজর রাখবার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি” ।

সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশমালা পেশ করা হয়:
“১. বোমাং সার্কেল চীফ, সংশ্লিষ্ট মৌজা হ্যাডম্যান-এর সুপারিশ ব্যতীত বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহ্যবাহী ভূমি ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতির সুস্পষ্ট লংঘন। তাই সার্কেল চীফ ও মৌজা হেডম্যানের সাথে আলোচনার পূর্বে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা।
২. এই বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, বোমাং সার্কেল চীফ, মৌজা হেডম্যান এবং মৌজাবাসীর সাথে সংলাপ-এর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৩. ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচী ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা”।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন