বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে বেঁচে যাওয়া ইয়াসমিনের শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা

ডেস্ক রিপোর্ট:

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনে বাঘাইরহাট ও মাচালং ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হন অনেকেই।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাঘাইছড়ি ফিরছিলেন ওই দুটি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারা।

তাদের বহনকারী দুটি গাড়ি দীঘিনালা বাঘাইছড়ি সড়কের নয় কিলোমিটার এলাকায় পৌঁছানোর পর পাশের পাহাড় থেকে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা হামলা করে।

সোমবার রাতেই আহতদের তিনটি হেলিকপ্টার যোগে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। আনার পথে মো. তৈয়ব আলী নামে এক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা মারা যান।

এছাড়া গুরুতর আহত সাতজনকে মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

এ ঘটনার শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার। নিজে প্রাণে বেঁচে গেলেও ওই ঘটনার পর কিছুতেই তিনি স্বাভাবিক হতে পারছেন না।

নির্বাচনে বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন ইয়াসমিন।

ইয়াসমিন বলেন, পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে সব হচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হল। এরপর আমরা গণনাও শেষ করলাম।

ইয়াসমিন জানান, ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ছিলেন ওই গাড়িতে।

তাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেশে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন।

তিনি বলেন, আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করল। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িটা।

ইয়াসমিন বলেন, তাদের গাড়িগুলো নয়মাইল এলাকায় পৌঁছানোমাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি শুরু হয়।

তিনি বলেন, কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। এ এক বিভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত…। রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একের পর এক লাশ।

গটনার বিবরণ দিতে দিতে কান্নায় ভেঙে পড়া ইয়াসমিন বলেন, সারা দিন আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক…,।

এরপর তিনি বলেন, এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছে। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাইতো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হল?

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইয়াসমিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যে কোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদেরকে নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এরকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরও বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এরপর রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান আরও একজন।

নিহতরা হলেন- পোলিং অফিসার আমির হোসেন ও আবু তৈয়ব, আনসার-ভিডিপি সদস্য মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম এবং মন্টু চাকমা।

সূত্র: যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন