বাঘাইছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর

ডেস্ক রিপোর্ট:

বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কাজ শেষে উপজেলা সদরে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে ৭ জন নিহত ছাড়াও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন ১৮ জন। গুলিবিদ্ধ ১১ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঘটনার রাতে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে মো. তৈয়ব মারা যান। অবস্থার আশঙ্কাজনক হওয়ায় সেখান থেকে রাত দেড়টার দিকে ৭ জনকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।

খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত ৭ জনের লাশ মঙ্গলবার বিকালের দিকে স্বজনদের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমএ মঞ্জুর।

নিহতরা হলেন আনসার ভিডিপি সদস্য মো. আল আমিন (১৮), পিতা মো. সেলিম উদ্দিন, কাচালং বাজার, বাঘাইছড়ি, মিহির কান্তি দত্ত (৩৮) গ্রাম-করেঙ্গাতলি, বাঘাইছড়ি, বিলকিছ আক্তার (৪০) আনসার ভিডিপি সদস্য, স্বামী- মজিবর রহমান, গ্রাম- পশ্চিম লাইলাঘোনা, বাঘাইছড়ি, জাহানারা বেগম (৩৫) আনসার ভিডিপি সদস্য, স্বামী- তপসি, গ্রাম- কাচালং বাজার, বাঘাইছড়ি, মোঃ আমির হোসেন ( ৩৮) সহকারী শিক্ষক, কিশলয় প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিতা- মৃতঃ আবু তাহের গ্রাাম- কাচালং বাজার কলোনি, বাঘাইছড়ি, আবু তৈয়ব (৪২) সহকারী শিক্ষক, নিউ লাইলাঘোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিতা- মৃত আবদুল কুদ্দুস মেম্বার, গ্রাাম- পুর্ব লাইলাঘোনা, বাঘাইছড়ি এবং । মিন্টু চাকমা (৩৪) পিতা- তপতি চাকমা, গ্রাম-মেরুং, দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি ।

ঘটনা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া এবং বাম আঙ্গুলে গুলি লাগা আনসার-ভিডিপি সদস্য মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ওই সময় ফেরার পথে পাহাড়ের ওপর থেকে এবং দুই পাশ থেকে অতর্কিতকভাবে ঝড়ের মতো গুলি বর্ষণ করা হয়। এতে সবাই গুলিবিদ্ধ হওয়ায় আমাদের হাতে অস্ত্র থাকলেও পাল্টা জবাব দেয়ার কোনো সুযোগ হয়নি। আমার বাম আঙ্গুলে গুলি লাগে। ভাগ্যের ফলে বেঁচে গেছি হয় তো।

সোমবার সন্ধ্যার দিকে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে ৭ জনকে নির্বিচারে গুলি করে মারার কেবল ১৫ ঘন্টার ব্যবধানে মঙ্গলবার সকালে আরেক উপজেলা বিলাইছড়িতে গুলি করে খুন করা হয়েছে, ওই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে।

এসব ঘটনায় আঞ্চলিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফকে দায়ী করছেন কোনো কোনো মহল। ফলে এসব নৃশংস ঘটনায় জনমনে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি করেছেন বিভিন্ন মহর। পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ তৎপরতায় নিরাপত্তাবাহিনী।

মঙ্গলবার সকালে বাঘাইছড়ির ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন, খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক, পুলিশের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ, পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবিরসহ অন্য সামরিক বেসামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তারা। ওই সময় তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদারের আশ্বাস দিয়েছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দুপুর দেড়টার দিকে বাঘাইছড়ি উপজিলা মিলনায়তনে মতবিনিময় সভা করা হয়। এসময় বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাদিম সারোওয়ার, বাঘাইছড়ি পৌরসভা মেয়র জাফর আলী খানসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এ সময় নিহতদের পরিবার প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নগদ ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের পরিবার প্রতি ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।

মতবিনিময় সভায় স্থানীয় জনগণ ঘটনাস্থল ৯ কিলোমিটার নামক স্থানে সেনাবাহিনীর একটি স্থায়ী ক্যাম্প করার জোর দাবি জানান। এ ছাড়া হতাহত পরিবারদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ বা সহায়তা দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক ওই স্থানে একটি পুলিশক্যাম্প স্থাপন এবং নিহত পরিবারের সদস্যদের থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে ১ জনকে করে সরকারি চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন।
এদিকে ঘটনার ব্যাপারে জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা।

এ ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস বইছে। কিন্তু কিছু মহল তা নস্যাত করতে উঠেপড়ে লেগে আছে। সোমবার বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে গুলি করে এবং পরদিন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যার ঘটনার উদ্দেশ্য তার মূল কারণ। তিনি এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, এ কারণেই আমরা পার্বত্য এলাকা হতে সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ তারা বারবার এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এসব ঘটনায় জড়িত এখানকার আঞ্চলিক দলগুলো। তিনি অবিলম্বে বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়ির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ওই দুটি ঘটনায় আঞ্চলিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ জড়িত। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘটনার প্রতিবাদে আজ (বুধবার) সকালে রাঙ্গামাটিতে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাঘাইছড়ি উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের শীর্ষনেতা সুদর্শন চাকমা বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে গুলি করে হত্যার ঘটনায় গোটা বাঘাইছড়ি এলাকায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আমি নিজেও আতঙ্কে। এ ঘটনায় জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফ (মূল) জড়িত। অবিলম্বে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া না হলে বারবার এ ধরনের ন্যাক্কারজনক হত্যাকান্ড ঘটানোর সাহস পাবে সন্ত্রাসীরা।

ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কেন্দ্রীয় নেতা মাইকেল চাকমা বলেন, বাঘাইছড়ির ঘটনা নির্বাচনী সহিংসতা। কিন্তু সেখানে আমাদের কোনো প্রার্থী ছিল না। কাজেই আমাদেরকে দায়ী করা সম্পূর্ণ অমূলক, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ওই ঘটনায় আমাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রশ্নই ওঠে না। ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে তা অত্যন্ত ঘৃন্যতম ও নিন্দনীয়। তাই যারা-ই ঘটাক, সঠিক তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছি আমরা।

বিলাইছড়ির সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যাসহ এসব ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের করা অভিযোগ অস্বীকার করে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নীলোৎপল খীসা বলেন, কিছু ঘটনা ঘটলে আমাদের ওপর দোষ চাপানো আওয়ামী লীগের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের কোনো ঘটনায় আমাদের কেউ জড়িত নেই। আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। মূলত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে আওয়ামী লীগের লোকজন জেএসএস’এর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগ করে আসছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন