বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে মিয়ানমার আর্মি ও আরাকান আর্মির মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ চলছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, পার্বত্যনিউজ:

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) চলমান সংঘর্ষ সামনের দিনগুলোতে আরো তীব্র হয়ে ওঠার আশংকা দেখা দিয়েছে। আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইং থুখা এ তথ্য জানিয়েছেন। তার দাবি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সম্প্রতি চিন রাজ্যের পালেটওয়া টাউনশিপে ৩০ ব্যাটালিয়ন সেনা নিয়ে বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছে। জায়গাটা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি।

মুখপাত্র জানান, ২৯ নভেম্বর সারা দিন ছয়টি জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে তাতমাদাও (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) হামলার কাজে দুটো হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে।

“ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন পালেটওয়াতে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষ হচ্ছে খুবই তীব্র। অনেক তাতমাদাও হতাহতও হয়েছে”, বললেন খাইং থুখা।

“তারা যদি এ সংঘাত চালাতে থাকে, আমাদের আত্মরক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর এতে সংঘর্ষ শুধু বাড়তেই থাকবে”, আরও বললেন তিনি।

“নভেম্বরের শুরু থেকে যে সংঘর্ষ চলছে, তাতে আরাকান আর্মির অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েকজন” এ তথ্য দিয়ে খাইং থুখা বোঝাতে চাইলেন যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে হতাহত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

আরাকান আর্মি কখন পালেটওয়াতে সামরিক অভিযান শুরু করবে – নিরাপত্তার কারণে সে তথ্য জানাতে অবশ্য মুখপাত্র অস্বীকার করেন।

২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় আরাকান আর্মিকে লক্ষ্য করে তাতমাদাও বোমাবর্ষণ শুরু করার পর পালেটওয়া থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ স্থানীয় অধিবাসী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে। এ তথ্য জানালেন ভারতে বসবাসরত বৌদ্ধ ভীক্ষু উ পিন্যা জোতা।

৩০ নভেম্ভর ওই ভীক্ষু ‘ইরাবতি’কে জানান, পালেটওয়ার প্রায় দুই হাজার অধিবাসী সীমান্তের ওপারে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে গত সপ্তাহে।

“আরাকানী গ্রামগুলো যতটা পারা যায় সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ভারত সরকার কিছু চাল দিয়েছে তাদের। প্রায় সাড়ে তিনশ লোক এসেছে গতকাল (নভেম্বর ২৯)। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাতমাদাও বোমা বর্ষণ শুরু করার পর তারা পালিয়ে আসে”, জানালেন উ পিন্যা জোতা।

সামরিক নেতারা বরাবর বলে আসছেন, আরাকান আর্মি অস্ত্র না ছাড়লে তাদের সাথে কোন শান্তি আলোচনা হবে না। কারণ, তাদের প্রতিষ্ঠা হয়েছে মাত্র ২০১১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট উ থেইন সেনের অধীনে মিয়ানমারের একটা আধা-বেসামরিক সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর। তবে আরাকার আর্মি- যারা উত্তর ও উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারে কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় কাচিন, তা’আঙ এবং কোকাং সেনাদের সাথে মিলে যুদ্ধ করেছে- তারা অবশ্য বলছে তাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছে ২০০৯ থেকে।

স্থানীয়দের ধারণা, পালেটওয়া টাউনশিপ এলাকায় ১৮ নভেম্বর আরাকান আর্মির হামলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দু’জন অফিসার ও নয়জন অন্যান্য স্তরের সদস্যসহ ১১ সেনা নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ হিসেবে তাতমাদাও এই হামলা চালাচ্ছে।

আরাকান আর্মির তথ্যমতে, মেইক ওয়া’র (ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম) কাছে সংঘর্ষ চলছে ২৫ নভেম্বর থেকে। আর মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিমুখী সীমান্তের কাছে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে ২৯ নভেম্বর।

এ সংঘর্ষে তাতমাদাওয়ের দুইটি ৬০ মিলিমিটারের লঞ্চার, ৭০টি ৬০ মিলিমিটার মর্টার শেল, কিছু গোলাবারুদ এবং সামরিক সরঞ্জামা দখল করেছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করে।

ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু এক প্রতিবেদনে বলছে, শিন রাজ্যে নতুন করে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে সেখানকার বাসিন্দারা ভারতের দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনে বর্মী সেনাবাহিনীর অভিযানে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে মিয়ানমার। এর মাঝেই শিন রাজ্যে আরাকান আর্মির সদস্যদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে মিয়ানমার থেকে শ’ শ’ মানুষ ভারতে প্রবেশ করছে।

মিজোরামের লংলাই জেলার এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ভারতীয় এই দৈনিক বলছে, শিন রাজ্যের অস্থিতিশীলতায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ার ঘটনা গত কিছুদিনের মধ্যে চারবার ঘটলো। চলতি মাসের শুরুর দিকে শিন রাজ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পালেতওয়া এলাকায় আরাকান আর্মির সদস্যদের সঙ্গে ওই সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অন্তত ১১ সদস্য নিহত ও আরো ১৪ জন আহত হয়। মিয়ানমারের দৈনিক দ্য ইরাবতি দেশটির সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, হতাহতের ওই ঘটনা ঘটেছে কালাদান নদীতে একটি নৌকা লক্ষ্য করে আরাকান আর্মির গোলা নিক্ষেপের পর।

দ্য হিন্দু বলছে, রাখাইনের পার্শ্ববর্তী এই রাজ্যে গত ৮ নভেম্বর থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। পালেতওয়ার পাশের দুটি গ্রামে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। শিনের এই সংঘর্ষের ঘটনার পর রাখাইনের উত্তরাঞ্চলেও দুই পক্ষের লড়াই বৃদ্ধি পেয়েছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে রাখাইন ও শিন প্রদেশে আরাকান আর্মির সদস্যরা ক্রমান্বয়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে তারা।

২০১৬ সালে দেশটির বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারের শান্তি-প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়। সেই সময় শান্তির প্রক্রিয়ার একটি রেফারেন্স গাইডে বলা হয়, আরাকান আর্মি গঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্ত¡শাসিত অঞ্চল গঠনই এই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। অপর বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) মিত্র গোষ্ঠী হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। তাদের অর্ধেকের বেশি সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয় কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি।

আরাকান আর্মির অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ও কেআইএ নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। রাখাইনের কিয়াকত্য, ম্রক-ইউ ও মিনবিয়াসহ শিনের পালেতওয়া এলাকায় সক্রিয় রয়েছে আরাকান আর্মি। কেআইএ, এএ ও তা’আঙ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও কোকাংভিত্তিক মিয়ানমার ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি মিলে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট গঠন করেছে।

২০১৫ সালে দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরকারের স্বাক্ষরিত দেশব্যাপি জাতীয় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। গত বছর সীমান্ত বাণিজ্য অঞ্চলে একাধিকবার হামলা ও মান্দালয়-ল্যাসিও-মিউস মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তা সাময়িক বন্ধ করে রাখে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। দ্য হিন্দু, দ্য ইরাবতি, সাউথ এশিয়ান মনিটর।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন