বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী হতে চাওয়ার প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত ভাবনা

তিমির মজুমদার:

বাংলাদেশে বসবাসরত  বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র  জাতিসত্ত্বা ও বিভিন্ন গোত্র পরিচয়ের জনসাধারণকে সাংবিধানিকভাবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে “The United Nations Declaration on The Rights of Indigenous People” বা “আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র” জারী হবার পর, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিরা হঠাৎ করেই নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মিডিয়ার একাংশ, সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তিবর্গ ও আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তাদের এই দাবী দিনের পর দিন আরও জোরালো হচ্ছে। তাদের এই দাবীর প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, ভৌগলিক অখণ্ডতা, জাতীয় সংহতি ও স্বাধীন দেশের অস্তিত্বের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব এই প্রবন্ধের বিবেচ্য।

আদিবাসী বলতে কি বুঝায়? এর সংজ্ঞা কি?  যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিন, নিউজিল্যান্ডের মাউরি, রাশিয়ার মেনেট, জাপানের আইনু, ফ্রান্স ও স্পেনে বাসকু, দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা ও মায়া, আরবের বেদুইন প্রভৃতি জনগোষ্ঠী যারা সুপ্রাচীনকাল থেকে স্ব স্ব ভূখণ্ডে বসবাস করেছেন তারা আদিবাসী হিসেবে বিশ্বে সর্বজন স্বীকৃত ও সুপরিচিতি। এখানে উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ানগণ অষ্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করলে তাদের অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না। আভিধানিক সংজ্ঞায় আদিবাসী শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Indigenous’ অথবা ‘Aborigine’ যার অর্থ হচ্ছে ‘Native Born, Originating or Produced Naturally in a Country, not Imported’ অথবা  Belonging to a particular place rather than, coming to it from somewhere else.’ যার বাংলা প্রতিশব্দ/অর্থ হচ্ছে ‘দেশী’, স্বদেশজাত, দেশীয়; বৈদেশিক অথবা বহিরাগত নয়।

অন্যদিকে নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় ‘আদিবাসী’ হচ্ছে কোন স্থানে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, বসতি স্থাপন, ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ কোন ইতিহাস জানা যায়নি। (The Indigenous are the groups of human race who have been residing in a place form time immemorial. They are the true sons of the soil: Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972)।

এখন দেখা যাক জাতিসংঘ উপজাতি ও আদিবাসীর সংজ্ঞা কিভাবে নির্ধারণ করেছে। এই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labor Organization-ILO) এর ৫ জুন ১৯৫৭ তারিখের ৪০তম অধিবেশনের কনভেশন- ১০৭ এবং ৭ জুন ১৯৮৯ তারিখের কনভেশন- ১৬৯ এ আদিবাসী ও উপজাতির সংজ্ঞা এবং এর সাথে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সংযোজন করা হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে ৬১তম অধিবেশনের ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ যার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে, সেটিতে উপজাতিদের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই এবং আদিবাসীদের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়নি।

Indigenous and Tribal Populations Convention,1957(No. 107)

Article 1: This Convention Applies to:

(a)     members of tribal or semi-tribal populations in independent countries whose social and economic condition are at a less advanced stage than the stage reached by the other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations.

(অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অন্যান্যদের চেয়ে অনগ্রসর এবং যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আইন অথবা  বিশেষ আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদেরকে উপজাতি অথবা উপ–উপজাতি বলে গণ্য হবে)।

(b)     members of tribal or semi-tribal populations in independent countries which are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization and which, irrespective of their legal status, live more in conformity with the social, economic and cultural institutions of that time than with the institutions of the nation to which they belong.

(অর্থাৎ যে সকল জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া অথবা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে এবং যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে তারা আদিবাসী বলে গণ্য হবে)।

Indigenous and Tribal Populations Convention, 1989 (No. 169) Article 1 :

This Convention Applies to:

(a)     tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially be their own customs or traditions or by special laws or regulations.

(অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তারা উপজাতি বলে গণ্য হবে)।

(b)     peoples in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions.

(অর্থাৎ যে সকল জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া অথবা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে এবং যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে তারা আদিবাসী বলে গণ্য হবে)।

উপরোল্লিখিত দুটি সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্বে থেকে বসবাস করা। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি একই রকম। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠী উপজাতি অথবা আদিবাসী হবেন উপরোক্ত শর্তের ভিত্তিতে। আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি বাংলাদেশর চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণের ক্ষেত্রে বিচার করা হয় তাহলে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, এরা আদিবাসী নয়;  উপজাতি।

এখন পর্যবেক্ষণ করা যাক বাংলাদেশর জন্য ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনের ‘United Nation Declaration on the Rights of Indigenous Peoples’ বা  ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’টি কতটা প্রযোজ্য। ঘোষণাপত্রটির উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এটি অনেক ক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ নয় এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই ঘোষণাপত্রের নিম্নোক্ত ধারাগুলি বিশেষভাবে অধ্যায়ন করা প্রয়োজনঃ

Article 3

Indigenous peoples have the right to self-determination. By virtue of that right’ they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development. অর্থাৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করতে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখতে পারবে।   

Article 4

Indigenous peoples, in exercising their right to self-determination, have the right to autonomy or self-government in matters relating to their internal and local affairs, as well as, ways and means for financing their autonomous functions.

অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার চর্চার বেলায় তাদের আভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্বশাসন বা স্ব শাসিত সরকারের অধিকার থাকবে এবং তাদের স্ব শাসনের কার্যাবলীর জন্য অর্থায়নের পন্থা ও উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার থাকবে।

Article 5

Indigenous peoples have the right to maintain and strengthen their distinct political, legal, economic, social and cultural institutions, while retaining their right to participate fully, if they so choose, in the political, economic, social and cultural life of the State.

অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনী, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার থাকবে।

Article 10

Indigenous peoples not be forcibly removed from their lands or territories. অর্থাৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি বা ভূখণ্ড থেকে জোর করে অন্য কোথাও সরানো যাবে না।

Article 30

Military activities shall not take place in the lands or territories of indigenous peoples, unless justified by relevant public interest or otherwise freely agreed with or requested by the indigenous peoples concerned.

 অর্থাৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা  যাবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তিগ্রাহ্য হবে অথবা যদি সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতিজ্ঞাপন বা অনুরোধ করে।

জাতিসংঘ সনদগুলোর বর্তমান অবস্থা কি? Indigenous and Tribal Populations Convention-1957 (No. 107) ১৯৫৭ সালে পাশ হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭ টি দেশ এই কনভেনশনটি র‍্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বাংলাদেশও কনভেনশন- ১০৭ র‍্যাটিফাই করেছিল। পরবর্তীতে কনভেনশন- ১৬৯ পাশ হবার পর কনভেনশন ১০৭ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তামাদী হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ অদ্যাবধি কনভেনশন- ১৬৯ র‍্যাটিফাই করেনি। তাই এটি বাংলাদেশের জন্য অবশ্যপালনীয় নয়। এখানে লক্ষণীয় যে, ইতোমধ্যে ৮টি দেশ এই কনভেনশনকে নিন্দা করে তা থেকে বেরিয়ে গেছে।

অন্যদিকে Indigenous and Tribal Populations Convention-1989 (No.169), ১৯৮৯ সালে পাশ হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২২ টি দেশ এই কনভেনশনটি  র‍্যাটিফাই করেছে।  এই উপমহাদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশ এই কনভেনশনটি র‍্যাটিফাই করেনি। অন্যদিকে, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ভোটদানের সময় ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বিরুদ্ধে ভোট দেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই দেশগুলোতে আদিবাসীরাই ছিল এক সময়ে মূল জনগোষ্ঠী এবং জাতিগতভাবে যাদের সংখ্যা বিপদজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

বিস্ময়কর অথবা পরিহাসের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের আদিবাসীদের রক্ষায় খুব সোচ্চার ও পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু নিজ দেশের জন্য আইএলও কনভেনশন- ১০৭ বা ১৬৯ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের স্বাক্ষরকারী নয়, পক্ষে ভোট দেয়নি এবং র‍্যাটিফাইও করেনি। কাজেই তাদের কুমিরের অশ্রু বর্ষণের কারণ ও মতলব বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হবার প্রয়োজন নেই। এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলোর উপজাতি, আদিবাসী কিংবা ক্ষ্রদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য এই মায়াকান্নার পেছনে মূলত ভূ–রাজনৈতিক, ভূ–অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি অধিপত্যবাদী স্বার্থই প্রকাশ্যে কিংবা অবচেতনে প্রবলভাবে কাজ করেছে একথা নির্দিধায় বলা যায়।

তাহলে বাংলাদেশে সত্যিকার আদিবাসী কারা? নিঃসন্দেহে বাঙালী ও বাংলা ভাষাভাষীরা এদেশের সত্যিকারের আদিবাসী। কারণ এরাই  প্রোটো–অষ্ট্রেলিয়েড (Proto Astroloid) নামের আদি জনধারার অংশ এবং তারাই একমাত্র আদিবাসী বা  Son of the Soil বলে দাবি করতে পারে। এর পেছনে জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণও রয়েছে। বাংলাদেশের এই অঞ্চলে বাঙালিরা বসবাস করে আসছে চার হাজার বছরেরও পূর্বে থেকে। বিক্রমপুর, ওয়ারি–বটেশ্বর, সোনারগাঁও কিংবা মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত নৃতাত্তিক প্রমাণাদি এসব বিষয় নিশ্চিত করে।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান উপজাতি চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল আরাকানে, ত্রিপুরাদের আদি বসবাস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবং মার্মা জনগোষ্ঠী এসেছে বার্মা থেকে। সেই অর্থে তারা কেউই বাংলাদেশের আদিবাসী নয় বরং তারা এদেশে অভিবাসী। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশের নানাস্থানে অভিবাসিত হয়ে আনুমানিক তিনশ থেকে পাঁচশ বৎসর পূর্ব থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাস করতে শুরু করেছে। তাই কোনোক্রমেই বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, অন্যান্য ক্ষ্রদ্র নৃগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী হতে পারে না। যারা তাদের আদিবাসী বলে আখ্যায়িত করছেন তারা শুধু সংবিধান লংঘন করছেন তা নয় বরং তারা জেনে শুনে মিথ্যাচার করেছেন।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো যে আদিবাসী নয় তার প্রমাণ কি?  বাংলাদেশের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপূত্র নয় তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ Robert Henry Sneyd Hutchinson তার বই  ‘An Account of Chittagong Hill Tracts’ (1906), Captain Thomas Herbart Lewin তার বই ‘The Chittagong Hill Tracts and Dwellers There in’ (1869) অমেরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬) প্রমুখের লেখা, গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। তারা সবাই একবাক্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতীয়দের নিকট অতীতের কয়েক দশক থেকে নিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এদেশে স্থানান্তরিত বা অভিবাসিত হবার যুক্তি প্রমাণ ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক Captain Thomas Herbart Lewin  এর মতে, ‘A greater portion of the hill tribes, at present living in the Chittagong Hills, undoubtedly came about two generations ago from Arracan.  This is asserted both by their own traditions and by records in the Chittagong Collectorate (Lewin 1869, 28). অর্থাৎ মাত্র দুই পুরুষ আগে ব্রিটিশদের সাথে বার্মা যুদ্ধের সময় চাকমারা পার্বত্য অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে যা চট্টগ্রাম কালেক্টরেট অফিসে রক্ষিত দলিল দস্তাবেজ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী সদস্যরা ১৭৮৪ সনে এ অঞ্চলে বার্মা থেকে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করে (Shelly, 1992 এবং Lewin, 1869)।

বিশিষ্ট ব্রিটিশ চাকমা পন্ডিত অমেরেন্দ্র লাল খিসা ‘অরিজিনস অব চাকমা পিপলস অব হিলট্রেক্ট চিটাগং’এ লিখেছেন, ‘তারা (চাকমারা)এসেছেন মংখেমারের আখড়া থেকে’। পরবর্তীতে  আরাকান এবং মগ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করেন। আড়াইশ থেকে তিনশ বছর পূর্বে তারা উত্তর দিকে রাঙ্গামাটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন’। এ বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রব, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. খুরশীদা বেগম, বিজয় কী বোর্ডের উদ্ভাবক জনাব মোস্তফা জব্বার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেছেন এমন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক জনাব মেহেদী হাসান পলাশ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়। এছাড়া মার্মা সার্কেল চীফ অংশু প্রু চৌধুরী প্রদত্ত বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও সাক্ষাৎকার এবং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তিক্তে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপজাতি হিসাবে পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে ‘আদিবাসী’ হিসেবে নয় (বিস্তারিতঃ https://www.youtube.com/watch?v=_IlixQ1SS6s)

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী আখ্যায়িত করেল অসুবিধা কি?   অনেককেই এটি বলতে শোনা যায় যে, আদিবাসী বললে যদি ওরা খুশী হয় বা খুশী থাকে তাহলে সমস্যা কি?  বিভিন্ন লেখা এবং দুই একটি সরকারী প্রজ্ঞাপনে এমনকি কোর্টের রায়ে পর্যন্ত অবচেতনভাবে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এ থেকে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে হতে পারে কিন্তু কিন্তু পরবর্তীতে ‘ইষ্ট তিমুর’ কিংবা ‘সাউথ সুদান’ এর মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার দায়ভার নিতে কি আমাদের সেই সব বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া ভালো প্রস্তুত আছেন?

সকলের জ্ঞাতার্থে এখানে উল্লেখ্য করা অপ্রাসাঙ্গিক হবে না যে  ‘ইষ্ট তিমুর’ এবং ‘সাউথ সুদান’ এর মত একই পরিস্থিতি কাশ্মীর, চেচনিয়া, ফিলিপাইনের মিন্দনাও এবং পৃথিবীর আরও কিছু স্থানে বিরাজ করলেও সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত করে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি এবং হবার কোন সম্ভাবনাও নেই। তাছাড়া স্বাধীনতার পরপরই পার্বত্য চট্রগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি অংশ স্বাধীন ‘জম্মুল্যান্ড’ স্থাপন করার জন্য এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত চেষ্টায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একাংশ এখনও জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং জেএসএস (সংস্কার) এর নামে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম চালু রেখেছে। কাজেই ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আদায় করতে পারলে জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী তারা ‘জুম্মল্যান্ড’ দাবী করবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

কেননা ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র- ২০০৭’ অনুযায়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করলে সেই অনুযায়ী তাদের স্বায়ত্বশাসন, রাজনৈতিক, আইনী, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা প্রদান করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। বিশেষ করে এই ঘোষণার ধারা ৩০ অনুযায়ী ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তিগ্রাহ্য হবে, অন্যথায় যদি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতিজ্ঞাপন বা অনুরোধ না করে।

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর ভূমি বা ভূখণ্ড ব্যবহারের আগে যথাযথ পদ্ধতি ও বিশেষ করে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিশেষ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি গ্রহণ করার বিষয়টি সেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আর যদি তারা ‘স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন’ না করে তাহলে কি হবে? যদি কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বহির্বিশ্বের কারো সঙ্গে কোনো অশুভ আঁতাত করে? যদি বহির্বিশ্ব থেকে ওই অঞ্চল আক্রান্ত হয় তবে সরকার কি সামরিক কার্যক্রম গ্রহণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কারো সম্মতির অপেক্ষায় নিস্ক্রিয় থাকবে?  যদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতৃত্ব সম্মতি না দেয় তাহলে কি হবে? বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ অথবা এর কোন অঙ্গ সংগঠনের মত অনুযায়ী যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করতে পারে।

এছাড়াও বাংলাদেশে কম–বেশি ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ‘মালিকানাধীন’ ভূমি আছে এবং তারা যদি সেই ভূমি বা ভূখন্ড ব্যবহারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর এত বিধি–নিষেধ আরোপ করে তাহলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কী হবে?  এই সকল প্রশ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করতঃ সকলকে এই বিষয়টিতে সতর্ক হতে হবে এবং ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’দের ‘আদিবাসী’ বলা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও প্রচুর চাকমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্য ট্রাইবাল জনেগোষ্ঠী রয়েছে। তারা সেখানে উপজাতি বা Schedule Cast হিসেবে পরিচিতি এবং সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সেখানকার কোন মিডিয়া কিংবা বুদ্ধিজীবী তো তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবার আন্দোলন করছেনা।

উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা আমাদের মোট ভূখন্ডের দশভাগের একভাগ (১৩,২৯৫ বর্গ কিঃ মিঃ/৫,১৩৩ বর্গ মাইল) এবং এখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা এক ভাগ (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ১৫,৯৮,২৯১ জন) মানুষ বাস করে। এ এলাকায় জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে যারা অবচেতনে উস্কে দিচ্ছেন তারা কি জানেন যে, এখানে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষূদ্র নৃগোষ্ঠী এবং বাকী অর্ধেক বাঙালী। মাত্র দশ বছর আগে থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের দাবীকৃত আদিবাসী হবার প্রবল ইচ্ছা আসলে জাতিসংঘের ২০০৭ সালের ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে’র বিভিন্ন ধারা থেকে ভবিষ্যতে ফায়দা লোটার কৌশল। এই কৌশলের ফাঁদে পা দেয়া ভয়ংকর এবং বিপজ্জনক। কারণ তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ তার এক দশমাংশ ভূমির মালিকানা হারাতে পারে যার সাথে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির ভৌগলিক অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভূখণ্ডের একদশমাংশ ছেড়ে দিতে কি আমরা প্রস্তুত? যার উত্তর অবশ্যই ‘না’। কাজেই সকলকে সতর্ক হতে হবে এবং এদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ বলা বন্ধ করতে হবে। আশা করা যাচ্ছে যে, এই রচনা পাঠ করার পর আর কেউ স্বজ্ঞানে বা অবচেতনে বাংলাদেশে বসবাসরত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’দের ‘আদিবাসী’ সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকবেন।

(লেখক- শিক্ষাবিদ ও উন্নয়নকর্মী)

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন