পেকুয়ায় রুপাইখাল দখলের মহোৎসব

পেকুয়া প্রতিনিধি:

পেকুয়ায় চলছে রুপাইখাল দখলের মহোৎসব। স্থানীয় ভূমিগ্রাসী চক্র বদ্ধ এ জলমহাল জবরদখল তৎপরতায় লিপ্ত। তারা এক সময়ের খরস্রোতা রুপাইখাল দখল মহোৎসবে মেতেছে। রুপাইখালের জেগে ওঠা চর ভরাট করে সেখানে তৈরি করছে লবণ চাষের জমি আর বসতবাড়ি। এতে করে সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানের অন্তর্ভূক্ত বিপুল সম্পত্তি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রুপাইখাল মগনামা ইউনিয়নের মৎস্য প্রজনন ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের অন্যতম উৎস। এ খালে মৎস্য আহরণ করছে শত শত জেলে। তারা প্রানপন চেষ্টা করছে খাল অবমুক্ত রাখতে। জবরদখল ঠেকাতে ও বন্দোবস্তীসহ লিজ কার্যক্রম স্থগিত রাখতে মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করা হয়। বিচারপতি জাফর আহমদ ও নাঈমা হায়দারের হাইকোর্ট বেঞ্চে সেটি শুনানীধীন আছে। তবে এ সব অমান্য চলছে রুপাইখালে।  সম্প্রতি রুপাইখাল দখলের মহোৎসব আরও জোরালো হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মগনামার ধারিয়াখালি অংশে রুপাইখাল জবরদখল অব্যাহত রয়েছে। ধারিয়াখালী এলাকার মৃত ফেরদৌসের ছেলে ইউনিয়ন যুবদলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন রুপাইখাল দখলের প্রচেষ্টায় লিপ্ত। কাটাফাঁড়ি সোনালী বাজার সড়কের লায়ন মুজিবের বাড়ির নিকট রুপাইখাল অংশ দখল চলছে। ইখতিয়ার উদ্দিন তার বাড়ির দক্ষিণ পাশের রুপাইখাল দখলের মহোৎসব অব্যাহত রাখছে। সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানের খাল শ্রেণীর ওই সম্পত্তির প্রায় ৫ একর তার কব্জায় নিয়ে যায়। গত ১ মাস আগে থেকে খাল দখল কাজ চলমান রাখে। প্রায় ৫ একর রুপাইখাল বর্তমানে যুবদলের এ শীর্ষ ক্যাডারের কব্জায়। প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি খাল দখলে নিতে সেখানে বাঁধ তৈরি করে। স্ক্যাভেটর দিয়ে মাটি ভরাট করে খালের প্রবাহমান অংশ দখলে নেয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, রুপাইখাল এক সময় প্রচণ্ড খরস্রোত ছিল। এর অবস্থান ছিল বঙ্গোপসাগরের সাথে। পশ্চিমে কুতুবদিয়া চ্যানেল, পূর্বদিকে কাটাফাঁড়ি নদী এ সঙ্গমস্থলে রুপাইখালের উৎপত্তি। ব্রিটিশ সময়ে রুপাইখাল কৃত্রিম শাসনে চলে যায়। বাঁধ দিয়ে এর গতি থেমে দেওয়া হয়। এক সময় মরাখালে পতিত হয়। মিষ্টি পানির বিশাল উৎস ছিল এ খাল। শুষ্ক মৌসুমে গভীর এ খালের পানি থেকে ফসল উৎপাদন হত অবিভক্ত মগনামায়। মগনামা ইউনিয়নের দরদরিঘোনা থেকে এসে রুপাইখাল থেমে যায় লায়ন মুজিবের বাড়ির নিকট। একে বাঁকে এ খাল দরদরিঘোনা, ব্যাঙকুয়াল ঘোনা, বাইন্নাঘোনা, রুকের চর, দারিয়াখালী ও কুমপাড়া হয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার বিস্তৃত কাটাফাঁড়ি সোনালী বাজার সড়কের আমজাবর বাড়ির নিকট বেড়িবাঁধে এর গতি থামিয়ে দেয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১শ ৭০ একরেরও অধিক রুপাইখালের আয়তন। এক সময় প্রচণ্ড গভীর ছিল খালটি। বর্তমানে খালের বিপুল অংশ পলি জমে ভরাট হয়ে যায়। দরদরিঘোনার অংশে খাল নেই। চাষীরা লবণ উৎপাদন করছে এ খালে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জিয়া ও এরশাদ সরকারের সময় বন্দোবস্তী মুলে দখলে দেয় স্থানীয়দের। ৯০ দশকের পর বিএনপি সরকার দলীয় বিবেচনায় নেতা-কর্মীদের অনুকুলে এ খাল লীজ দেয়। রুপাইখাল মগনামা ইউনিয়নের অর্থনীতির অন্যতম প্রানের স্পন্দন। সেটি সরকারের বদ্ধ জলমহল শ্রেণীভূক্ত সম্পত্তি। এ খালের দুপাড়ে মানুষের বসতি রয়েছে। সরকারের খাস জমিতে মানুষ বসবাস করছিল যুগ যুগ ধরে। তারা অত্যন্ত দরিদ্র। খাল থেকে মৎস্য আহরণ করে সংসার চালায়। এ ছাড়া রুপাইখাল পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম এ ইউনিয়নে। মধ্যম পূর্ব দক্ষিন পশ্চিম অংশের লোকালয়ের পানি এ খালের উপর দিয়ে গিয়ে নদীতে চলাচল করে।

লবণ চাষীরা জানায়, ইখতিয়ার উদ্দিন রুপাইখালের মুল পানি চলাচল পয়েন্ট দখলে নেয়। খালের মাঝপথে পানি চলাচলের অংশ। সেটিসহ রুপাইখালের প্রায় ৫ একর জায়গা দখলে নিতে মাটি ভরাট করে। সেখানে বাঁধ তৈবি করা হয়েছে। মগনামা ইউনিয়নের বাইন্নাঘোনা ও ধারিয়াখালীর লোকজন জানায়, রুপাইখাল ভূমিগ্রাসীদের নজরে এসেছে। এর আগেও অনেকে দখলের চেষ্টা করে। আমরা মৎস্য শিকারী ও লবণ চাষীরা আন্দোলন সংগ্রাম করে এদের হটিয়েছি। ইখতিয়ার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এক সময় ছাত্রদলের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিল। জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালে সে ছিল দুরন্ত ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। ওই বছর তার নেতৃত্বে ছাত্রদল ও যুবদল ক্যাডাররা সোনালী বাজারে বঙ্গবন্ধুর শোক দিবসের কাঙ্গালী ভোজে হানা দেয়। অস্ত্র স্বস্ত্র নিয়ে তারা রান্না করা মাংসের ডেকসি ছুড়ে মারে। শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলছিল। ইখতিয়ার মাইক্রোফোন ভাংচুরসহ তাণ্ডব চালায়। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের হামলা ও মারধর করা হয়। বর্তমানে যুবদলের রাজনীতির স্থানীয় শীর্ষ ক্যাডার।

এ দিকে রুপাইখাল দখল মহোৎসব চলছিল। ইখতিয়ার উদ্দিন বাঁধ তৈরি করে প্রায় ৫ একর দখলে নেয়। উপজেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউএনও ও ওসিকে তাগিদ দেয়। জেলা প্রশাসক কক্সবাজারকে অবহিত করা হয়। প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে। জবর দখলকারী ইখতিয়ার উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে সিদ্ধান্ত হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ডের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। পেকুয়া থানা পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয় মামলা রেকর্ড করে তাকে গ্রেফতার করতে। স্থানীয় ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আজিম বাদী হয়ে অভিযোগ দেয়। সেটি নিয়মিত মামলা রুজু করতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওসিকে নির্দেশনা দেয়। এর প্রেক্ষিতে ইউপি সদস্য নুরুল আজিম অভিযোগ দেয়। তবে সে সময় থেকে ওই অভিযোগ ঝুলন্ত আছে। অদৃশ্য কোন কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি এমনকি বাঁধ এখনও অপসারিত না হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার খুঁটির জোর কোথায় এখন এ প্রশ্ন মগনামায়। ইউএনও একাধিকবার ওই স্থান পরিদর্শন করেছেন। কানুনগো ও ভূমি অফিস বাঁধ অপসারণ করছিলেন।

সুত্র জানায়, সামান্য অংশ বাঁধ অপসারণ হয়েছে। ইউপি সদস্য নুরুল আজিম জানায়, ভূমি অফিস আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল বাঁধ অপসারণ করতে। তারা ২/১ দিন এসেছিল। আমার অভিযোগ এখনও মামলা হিসেবে রেকর্ড হয়নি। এ ভাবে চললে এ খাল ইখতিয়ারসহ ভূমিদস্যুরা গ্রাস করে ফেলবে। এ বিষয়ে জানতে ওসি পেকুয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পেকুয়ার কানুনগো শান্তি জীবন চাকমা জানায়, রুপাইখাল ১ নং খাস খতিয়ানভূক্ত সম্পত্তি। ইখতিয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। আমরা বাঁধ অপসারণ করেছি। স্ক্যাভেটর জব্দ করতে গিয়েছিলাম। তবে তারা স্ক্যাভেটরটি সরিয়ে ফেলে।  প্রয়োজনে আবার যাব।

এ বিষয়ে জানতে ইউএনও মাহাবুব উল করিম এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়, তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন