পাহাড় থেকে আসা অত্যাধুনিক অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে

bandarban-arms

কাজী সোহাগ, খাগড়াছড়ি থেকে:

এম কে-১১, জার্মানির তৈরি এইচ কে-৩৩, রাশিয়ার জি-৩, একে-৪৭, একে-২২, এম-১৬ রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, চাইনিজ সাব মেশিনগান, এসবিবিএল বন্দুক। এসবই বিদেশি অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে প্রায় নিয়মিত এসব অতাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে।

মানের দিক দিয়ে এসব অস্ত্র যেমন অত্যাধুনিক তেমনি দামের দিক দিয়েও ব্যয়বহুল। এম কে-১১ এর মতো অত্যাধুনিক রাইফেল দিয়ে প্রায় এক মাইল দূর থেকেও নিশানা করা যায়। এর কার্যকরী রেঞ্জ এক হাজার ৫শ’ গজ। প্রতি মিনিটে ফায়ার করা যায় ৭৫০ রাউন্ড। একটি নতুন এমকে রাইফেলের দাম প্রায় ৮ লাখ টাকা।

স্থানীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, পাহাড়িদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্র এখন পৌঁছে যাচ্ছে দেশে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গিদের হাতে। ব্যবহার হচ্ছে দেশবিরোধী সন্ত্রাসী কাজে। আটক জঙ্গিরা পাহাড় থেকে অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়টি এরইমধ্যে স্বীকার করেছে। জঙ্গিদের এ ধরনের তথ্যের পর তিন পার্বত্য জেলায় পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুর্গম এলাকার সুযোগ নিয়ে পাহাড়ে সক্রিয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্র কেনাবেচার রুট হিসেবে ব্যবহার করছে পার্বত্য জেলাগুলোকে। অন্যদিকে জঙ্গিরাও এ অঞ্চল থেকে অস্ত্র সংগ্রহকে নিরাপদ হিসেবে মনে করছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে থাকা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে তারা। বিষয়টিকে রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

bandarban-arms

এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, পার্বত্য অঞ্চল যেহেতু অস্ত্রের রুট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেহেতু এখান থেকে অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে যেতেই পারে। এটা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। এখানে নানা ধরনের নিরাপত্তা এজেন্সি কাজ করছে। তাদের উচিত হবে অস্ত্রের এসব রুট বন্ধ করা।

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত ও মিয়ানমার রয়েছে। তাদের সীমান্ত ঘিরে সক্রিয় রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তাদের যোগসূত্রে পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র আসতে পারে। একই প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মজিদ আলী মানবজমিনকে বলেন, আগে এ অঞ্চল দিয়ে অনেক বেশি অস্ত্র আসতো। এখন সেনাবাহিনী ও পুলিশের অভিযানের ফলে অনেক কমেছে। এটা এক ধরনের সফলতা বলে মনে করি।

তিনি বলেন, পার্বত্য জেলায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো দেশীয় অস্ত্র নয়। তাই বাইরে থেকে এসব অস্ত্র আসছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে গোয়েন্দাদেরও রিপোর্ট রয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও অস্ত্রের কানেকশন নিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে আটক অনেক জেএমবি সদস্য জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তারা পাহাড়ি অঞ্চল থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। এরপরই এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্ত পয়েন্টগুলো আরো সুরক্ষিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন গোয়েন্দারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়ে সক্রিয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সমতলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দাদের তালিকায় তিন পার্বত্য জেলায় অস্ত্র কেনাবেচায় সম্পৃক্ত থাকা ১৫ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নাম রয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (এআরএসও), ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকান (এনইউএ), আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি), পিপলস পার্টি অব আরাকান (পিপিএ), আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামী ফ্রন্ট (এআরআইএফ), ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আরাকান (ডিপিএ) ইত্যাদি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনদের জন্য সতর্কতা অবলম্বনের অংশ হিসেবে এরইমধ্যে সীমান্ত ঘেঁষা বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে অর্ধশত নতুন চেকপোস্ট। প্রয়োজন অনুযায়ী আরো নতুন চেকপোস্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে তারা জানান।

এদিকে তিন পার্বত্য জেলার বেশ কয়েকটি স্থানকে অস্ত্র আসার রুট হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে-বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকা, রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার চোট হরিণা, বড় হরিণা, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক, জুরাছড়ির আন্দারমানিক, ফকিরাছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার নারাইছড়ি, পানছড়ির দুদকছড়ি,  কেদারাছড়া, মাটিরাঙ্গা উপজেলার আচালং, রামগড় উপজেলার বাগানবাজার, বড়বিল, রামগড় বাজার ইত্যাদি।

এসব স্থান রুট হিসেবে ব্যবহারের অন্যতম কারণ হিসেবে অরক্ষিত সীমান্তকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে ২৮১ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্তের এরইমধ্যে ১৩০ কিলোমিটার সুরক্ষিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে থাকা ১৯৮ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্তের মধ্যে ৮৫ কিলোমিটার সুরক্ষিত করা হয়েছে। তারা জানান, সীমান্ত সুরক্ষিত করার অংশ হিসেবে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হচ্ছে চেকপোস্ট।

সূত্র: মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন