পাহাড়ে সামরিক কাঠামো তৈরি করে সশস্ত্র সংগঠনের দাপট

%e0%a6%a4%e0%a6%a6%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%a6

কাজী সোহাগ, রাঙ্গামাটি থেকে |
সামরিক কাঠামো তৈরি করে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে সশস্ত্র সংগঠনগুলো। তাদের রয়েছে নিজস্ব সেনাপ্রধান, আলাদা আলাদা কোম্পানি, বিভিন্ন উইং, শরীরে থাকে বাহিনীর পোশাক, হাতে অত্যাধুনিক ওয়াকিটকি, কাঁধে চকচকে ভারি ও দামি অস্ত্র। এরকম প্রায় ১৮শ সদস্য রয়েছে পার্বত্য জেলাগুলোতে। তারা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণ পাওয়া দক্ষ ও ক্ষিপ্র। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে তাদের বিচরণ।

শুধু পোশাক আর অস্ত্র নয় তাদের রয়েছে নিজস্ব পরিচয়পত্র, মুদ্রা ও পতাকা। পাহাড়ে জুম্মল্যান্ড ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠনকে টার্গেট করে নীরবে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে এই সশস্ত্র সংগঠনগুলো। সম্প্রতি ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের পতাকা, মুদ্রা ও পরিচয়পত্রের প্রচারণা চালাচ্ছে তারা। তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন এমন গোয়েন্দা সদস্যরা এসব তথ্য জানান।

তারা বলেন, পাহাড়কে অস্থিতিশীল করতে এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলো সম্প্রতি তৎপর হয়েছে। সাধারণ উপজাতিদের বিভ্রান্ত করে আবার কখনও বলপ্রয়োগ করে নিজেদের দলকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে তারা। এসব সশস্ত্র সংগঠনের তিনটি উইং খুবই শক্তিশালী। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থ উইং।

সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পার্বত্যাঞ্চলে ৩টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একেক এলাকায় একেক দলের প্রভাব ও আধিপত্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সমগ্র রাঙ্গামাটি জেলায়, খাগড়াছড়ি জেলার অল্প কিছু এলাকায় এবং বান্দরবানে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের মোটামুটি প্রভাব ও আধিপত্য রয়েছে বলে জানা যায়।

অন্যদিকে ইউপিডিএফ-এর আধিপত্য রয়েছে সমগ্র খাগড়াছড়ি জেলা, রাঙ্গামাটির কোন কোন এলাকা ও বান্দরবানের অল্প পরিমাণ এলাকায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে জেএসএস (সংস্কার) এর মোটামুটি প্রভাব ও আধিপত্য থাকলেও রাঙ্গামাটিতে অল্প পরিমাণে প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই তিন সংগঠনের রয়েছে প্রায় ১৮শ’ সশস্ত্র সদস্য। তারা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোশাক ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের রয়েছে ৮৭৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী।

তাদের অধীনে সামরিক কায়দায় ৬টি কোম্পানি রয়েছে। জেএসএস (সংস্কার) এর রয়েছে ২টি কোম্পানি। তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সংখ্যা ২৫০ থেকে ২৬০ জন। অন্যদিকে ইউপিডিএফ এর ৪টি কোম্পানির অধীনে রয়েছে প্রায় ৭ শতাধিক সশস্ত্র সদস্য। ক্যাপ্টেন বা মেজর পদবির সদস্যরা কোম্পানিগুলোর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। গোয়েন্দারা জানান, দুই উপায়ে সশস্ত্র সদস্যরা তাদের দল ভারী করার চেষ্টা করেন।

প্রথমত, তারা পার্বত্য অঞ্চলে খোঁজ করেন কোন কোন উপজাতির নামে মামলা রয়েছে অথবা অপরাধের দায়ে কাদের পুলিশ খুঁজছে। তাদের তালিকা তৈরি করে নানা প্রলোভন দেখিয়ে দলে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। আবার কিছু উপজাতিকে স্বাধীন পার্বত্য অঞ্চল অথবা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে প্রশিক্ষণসহ হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। এসব সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা আবার দল থেকে মাসিক হারে নিয়মিত বেতনও পান।

সম্প্রতি উদ্ভাস চাকমা ও রাজু চাকমা নামে দু’জনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পরে তারা পুলিশের কাছে নিজেদের সংগঠন ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়।

পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর এ ধরনের তৎপরতা প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, একটি সশস্ত্র গ্রুপ তিন পার্বত্য জেলাকে নিয়ে জুম্মল্যান্ড গঠন করতে চায় তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি হয়েছে। শান্তিচুক্তি কি আবারও হবে? হবে না। বরং শান্তি চুক্তি যেটা হয়েছে সেটাই হচ্ছে আমাদের অধিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে নিরন্তর কাজ করছেন।

তিনি বলেন, যারা এসব করছে তারা দেশদ্রোহী কাজ করছে। এসব সরকার ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। তবে সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী-ই। তাদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই।

একই প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, সশস্ত্র সংগঠনগুলো স্বাধীনতা চাচ্ছে কিনা আমার জানা নেই। তবে তারা ভূমি, বন ও পুলিশি ক্ষমতা পেতে চায়। আমি মনে করি এর অর্থ হলো সার্বভৌমত্ব চাওয়া। রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি আঞ্চলিক পর্যায়ে দেয়া উচিত নয়।

জেলা প্রশাসক বলেন, পার্বত্য জেলার মূল সমস্যা হলো ভূমি। এখনও এটা জরিপ করা হয়নি। যার কারণে নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চিঠি দিয়ে এরই মধ্যে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে ভর্ৎসনা পেয়েছি।

এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মজিদ আলী বলেন, যারা আলাদা পতাকা, মুদ্রা ও পরিচয়পত্র নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ-এর নামে এসব করা হচ্ছে। তাদের ওপর আমাদের নজরদারি রয়েছে।

এদিকে খাগড়াছড়িসহ অপর দুই পার্বত্য জেলায় ইউপিডিএফ-এর নামে চাঁদা চেয়ে নিয়মিত চিঠি দেয়া হচ্ছে। সেখানেও পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে। এরকম একটি চিঠি মানবজমিনের হাতে রয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে-

‘আমাদের প্রত্যাশা খাগড়াছড়ি পানছড়ি উপজেলা সদরে সবাই পার্টির আহ্বানে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবেন। সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের পুনঃস্বায়ত্তশাসন অর্জন সম্ভব বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিজয় আমাদের অনিবার্য। অর্থ বিভাগ,পানছড়ি ইউনিট। তারিখ- ১২/১২/২০১৬,পার্বত্য চট্টগ্রাম (খাগড়াছড়ি)।’

সূত্র- মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন