বান্দরবানের পাহাড়ে সমভূমি জাতের তুলা চাষীদের নতুন স্বপ্ন

Bandarban Pic-2 19.1

স্টাফ রিপোর্টার:

পাহাড়ে সমভূমি জাতের তুলা চাষ করে আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখছেন চাষীরা। ইতোমধ্যে পাহাড়ের ঢালে ও সমতল ভূমিতে তুলা চাষ করে অনেকে লাভবান হয়েছেন। অন্য জাতের থেকে ৬-৭ গুণ বেশি উৎপাদন হয় বলে সমভূমি জাতের তুলা চাষের দিকে ঝুকছে কৃষকরা। জেলার পাহাড়ে তুলাচাষ বৃদ্ধি পেয়ে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়ে চাষীদের মুখে ফুটেছে হাসি।

তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে ৫৯টি প্রদর্শনী প্লটসহ জমিতে সমভূমি ও পাহাড়ি জাতের ৫ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করা হয়েছিল। উৎপাদন করা হয়েছিল প্রায় ১৫৫০ মেট্রিক টন তুলা। ২০১৫ সালে ৩০০ হেক্টর চাষ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ২০০ হেক্টর চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন।

সূত্র জানায়, পাহাড়ে পানির অভাবে শত শত হেক্টর পাহাড়ি জমি শুস্ক মৌসুমে পতিত হয়ে থাকে। তুলা চাষে পানি কম লাগায় এবং অন্যান্য খরচ কম হওয়ায় সম্প্রতি বান্দরবানের পাহাড়ে উচ্চ ফলনশীল সমভূমি জাতের তুলা চাষ বাড়ছে। এছাড়া তুলার সাথে সাথী ফসল ধান ও আনারশ চাষ করা যায় বলেও তুলার প্রতি চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে।

একাদিক তুলা চাষী জানান, তুলা চাষে পানি কম লাগায় রবিশষ্য আবাদের পাশা-পাাশি তুলার আবাদ করা যায় বলে তা অত্যন্ত লাভজনক। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলা চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বিনামেূল্য বীজ, সার, কীটনাশক ও উপকরণ প্রদান করায় সমভূমি জাতের তুলা চাষের দিকে ঝুকছে কৃষকরা।

তবে চাষীরা মনে করেন, তুলার দাম বাড়ানোর পাশাপাশি সরকার তুলা উৎপাদনে আর্থিক ঋণ সহায়তা দিলে অনেক কৃষকই তামাক চাষ থেকে ফিরে তুলা চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়বে।

তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পোশাক শিল্পের চাহিদা মেঠাতে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে। সারাদেশে তুলা উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দেড় লাখ বেল অথাৎ চাহিদার মাত্র ৫%। আগামী বছর তুলা আমদানীতে চীনের স্থান দখল করবে বাংলাদেশ।

সূত্র জানায়, ১৯৮২ সাল থেকে বান্দরবানে তুলা উন্নয়ন বোর্ড সম্প্রসারণ কেন্দ্র চালু হলেও ২০১২ সাল পর্যন্ত পাহাড়ে জুমের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ি তুলা চাষে উৎসাহিত করতেন। ২০১৫-১৬ সালে পাহাড়ি ও সমভূমি জাতের ৩৩ শতক করে ১০৮টি প্রদর্শনী প্লটে কৃষকদের বিনামেূল্য সার, বীজ ও কীটনাশক বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া তুলা চাষীদের উৎসাহিত করতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড সম্প্রসারণ কেন্দ্রর মাধ্যমে বিনামেূল্য উন্নত জাতের সমভূমি ও পাহাড়ি জাতের বীজ বিতরণ করেছে।

তুলা উন্নয়ন সম্প্রসারণ কর্মকতারা জানান, চাষীদের চাহিদা অনুযায়ী বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করতে সরকারি মূল্যে তুলা চাষীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি পাহাড়ি ও সমভূমি জাতের তুলা ৫২.৫০ টাকায় ক্রয় করা হয়। অবশিষ্ট তুলা চাষীরা খোলা বাজারে বিক্রি করেন।

তুলা উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মংসানু মার্মা জানান, বান্দরবানের পরিবেশ ও আবহাওয়া সমভূমি জাতের তুলার অনুকূলে হওয়ায় পোকার আক্রমণ যেমন কম তেমনি ফলনও বেশি পাওয়া যায়। অন্য জাতের থেকে সমভূমি জাতের তুলা ৬-৭ গুণ বেশি উৎপাদন হয়।

তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াহাব জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম এক সময় কার্পাস মহল নামে পরিচিত ছিল। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে কৃষকরা পাহাড়ি তুলা চাষ করে আসছে। এ তুলা উৎপাদন কম হওয়ায় সমভূমি জাতের তুলার চাষ শুরু করা হয়েছে। এ জাতের তুলার উৎপাদন যেমন বেশি তেমনি মানও ভাল। বান্দরবান জেলায় চলতি বছর ৬ হাজার হেক্টর পাহাড়ি তুলা এবং ২০০ হেক্টর জমিতে সমভূমি জাতের তুলা চাষের আবাদ করা হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ২৯শ ২৪ মেট্রিক টন। সমভূমি ৫শ ২৭ এবং পাহাড়ি জাতের তুলা ২৪০০ মেট্রিক টন।

তিনি জানান, তুলার বীজ থেকে পশুর খাদ্য খৈল, ফ্যাক্ট মুক্ত তৈল ও ফাজ (ব্যন্ডেজ বা গজ) তৈরি করা হয়। গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলা সংকট দেখা দিলে দাম বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তুলার অভাবে দেশের কটন মিলগুলোর উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়। পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দেশে সমভূমি জাতের তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে সংকট কমার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।

জেলা সদরের বসন্ত পাড়ার রেমরু ¤্রাে জানান, আগে তারা পাহাড়ে জুম চাষে অন্যান্য ফসলের সাথে জুমের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ি তুলা চাষ করতেন। সম্প্রতি তারা পাহাড়ের ঢালে সমভূমি জাতের তুলা চাষ করে লাভবান হয়েছেন। প্রতি একরে জমিতে ৭-৮ হাজার টাকা খরচ করে প্রায় ৯-১০ মণের মত ফলন পেয়েছেন, যার বাজার মূল্য ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা। তাছাড়া জ্বালানী হিসেবে তুলা গাছ বিক্রি করে বাড়তি টাকাও আয় করা হয়।

তুলাচাষী মহন্দ্র তঞ্চগ্যা বলেন, পাহাড়ি তুলার চেয়ে সমভূমি জাতের তুলা চাষ অনেক বেশি লাভজনক। সমভূমি জাতের তুলার মান ভাল ফলনও বেশি দামও অন্য জাতের তুলার থেকে বেশি। এ জন্য বান্দরবানে সমভূমি জাতের তুলার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

কজেঅং মার্মা বলেন, সমভূমি বা উচ্চফলনীশল জাতের তুলার বিজ অপসারণ করে চরকায় সুতা তৈরি করে পরিবারের পরিধানের রকমারী পোষাক, শীতবস্ত্র ও চাদর বুনুন করে বাড়তি তুলা বাজারে বিক্রি করে অনেক লাভবান হয়েছি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন