পাহাড়ে মূর্তিমান আতঙ্ক ইউপিডিএফ: বাস্তুচ্যুত ৪শতাধিক নারী-শিশুর মানবেতর জীবনযাপন

বিশেষ প্রতিনিধি::
পাহাড়ে মূর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) মূল। এদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলা ও হুমকিতে বাস্তুচ্যুত হয়ে বিভিন্ন স্থানে শতাধিক পরিবারের ৪শতাধিক নারী-শিশুর মানবেতর জীবন করছে। শিক্ষা জীবন বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর।

এদিকে অপহরণ, চাদাঁবাজি, গুম, নির্যাতন, খুন, হামলা ও হুমকি লুটপাটের অভিযোগ এনে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ) সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসাকে প্রধান করে ৩৮ জনের বিরুদ্ধে রাঙামাটির সাজেক ও খাগড়াছড়ির পানছড়িতে পৃথক মামলা ও জিডি হলেও থামছে না সন্ত্রাসীদের তাণ্ডববলীলা। ফলে আতংকে বসতবাড়ী ছেড়ে এক কাপড়েই অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে সাধারণ পাহাড়িরা।

এছাড়াও রাঙামাটির নানিয়াচর ও খাগড়াছড়ির রামগড়ে দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রসীতের ইউপিডিএফ’র সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা, ভাংচুর ও হুমকিতে বেশ কিছু পরিবার বাড়ীঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রসীতের ইউপিডিএফ হুমকিতে আতংকে দিন কাটাচ্ছে জনপ্রতিনিধিরাও।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রসীতের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ) তাণ্ডবলীলা থেকে রক্ষা পেতে গত ১৫ এপ্রিল ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত রাঙামাটির বাঘাইহাট উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৪৯টি পরিবারের ১৩০ জন বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত এ মানুষগুলোর মধ্যে বাঘাইছড়ি সদর উপজেলার ৩০টি পরিবার, খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ১২টি পরিবার, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় ২টি পরিবার আশ্রয় নিলেও অপর ৫টি পরিবারের হদিস পাওয়া যায়নি।

একই সময় খাগড়াছড়ির মহালছড়ি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৩২টি পরিবারের ১৮০ জন। এদের মধ্যে মহালছড়ির ধনপতি বাজারে ২৮টি পরিবার ও খাগড়াছড়ি সদরে ৪টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

গত ১৯ এপ্রিল লক্ষ্ণীছড়ি থেকে ৩টি পরিবারের ১৩ সদস্য বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল দীঘিনালার বিভিন্ন স্থান থেকে ১২টি পরিবারের ৩৬ জন বাস্তুভিটা ছেড়ে দীঘিনালা সদর উপজেলায় আশ্রয় নিয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল পানছড়ির লোগাং থেকে বসতভিটা ছেড়ে ৩টি পরিবারের ১০ সদস্য খাগড়াছড়ি সদরে আশ্রয় নিয়েছে। একই দিন খাগড়াছড়ি সদরের ৪টি পরিবারের ১১ সদস্য খাগড়াছড়ি পৌর শহরে আশ্রয় নিয়েছে।

পক্ষান্তরে প্রতিপক্ষ জেএসএস(এমএন) গ্রুপের হুমকির মুখে গত ১৬ এপ্রিল দীঘিনালার ১টি পরিবারের ৫সদস্য দীঘিনালার বাবুছড়ায় আশ্রয় নিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তুচ্যুত অধিকাংশ পরিবারই এক ঘন্টার নোটিশে বসতবাড়ী ছাড়তে হয়েছে। কাউকে কাউকে রাতে বেলায় বাড়ী থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এক কাপড়ে। এদের অপরাধ তারা ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক কিংবা জেএসএস(এমএন) গ্রুপের কর্মী-সমর্থকদের স্বজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে আন্তর্দলীয় কোন্দল নতুন কিছু নয়। কিন্তু কখনোই তারা পরিবারগুলোর দিকে হাত বাড়ায়নি। শান্তি চুক্তির পুর্বেও এমন ঘটনার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এবারই প্রথম ইউপিডিএফ মূল প্রতিপক্ষের পরিবারের দিকে হাত বাড়ালো।

বৈসাবি উৎসবের শুরু থেকেই খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি, লক্ষীছড়ি, গুঁইমারা, দীঘিনালা, রামগড়, পানছড়ি ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ি এবং নানিয়ারচরসহ কয়েকটি উপজেলায় প্রসীতের ইউপিডিএফ’র সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন শুরু করে। অনেককে এক কাপড়েই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছে। অনেকের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে।

এদিকে অপহরণ, চাদাঁবাজি, গুম, নির্যাতন, খুন, হামলা ও হুমকি লুটপাটের অভিযোগে খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থানায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ) সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসাকে প্রধান আসামী করে অন্তত ৩৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে জিডি ও মামলা হয়েছে।
তার মধ্যে বাঘাইছড়ি থানায় গত ১৭ এপ্রিল দায়েকৃত মামলায় ইউপিডিএফ’র সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসাকে প্রধান করে আরো ১৬ জনকে আসামী করা হয়েছে। বাঘাইছড়ি থানায় মামলা নং-০১/০৩, ৪৪৮/৩২৩/৫০৬/৪২৭/৩৭৯/৩৮০ দন্ডবিধি।

মামলার বাদী তাসোনা চাকমা তার এজাহারে অভিযোগ করেন, ইউপিডিএফ’র সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসার নির্দেশে গত এপ্রিল বিকালে সন্ত্রাসীরা তার বাড়ীতে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করে এবং এক ঘন্টার মধ্যে এক কাপড়ে এলাকা না ছাড়লে সবাইকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার হুমকি দেয়। এসময় তারা আমার বাড়ী থেকে নগদ ২লাখ টাকা, ৩টি স্বর্ণের চেইন, ২জোড়া কানের দুল, ২টি আংটি, ১জোড়া নুপুর লুট করে নিয়ে যায়।

মামলার বিষরয়ে বাঘাইছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ আমির হোসেন বলেন, তাসোনা চাকমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা আসামীদের ধরতে পুলিশ অভিযান চালাছে। তবে মামলার অধিকাংষ আসামী সাজেক এলাকার হওয়ায় মামলাটি সাজেক থানাতেও পাঠানো হয়েছে।সাজেক থানার অফিসার ইনচার্জ নুরুল আনোয়ার জানান, আসামীদের ধরতে বাঘাইছড়ি ও সাজেক থানা যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে।

অপর দিকে গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাধারন ডায়েরী করেছেন, কালা সোনা চাকমা নামে এক গৃহবধূ। সাধারন ডায়েরী নং ৬৯৭/১৮। সাধারন ডায়েরীতে ইউপিএিফ’র সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসাসহ ২১ জন ইউপিডিএফ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

সাধারন ডায়েরীতে তিনি অভিযোগ করেন, গত ১৫ এপ্রিল সন্ত্রাসীরা তার পানছড়ি উপজেলার যোগেশ্বর গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে বাড়ী না ছাড়লে হত্যার হুমকি দেয়। তার চিৎকারে আশ-পাশের লোকজন এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে হুমকি অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় তিনি প্রাণ ভয়ে বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পালিয়ে এসেছেন বলে জানান।
জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সমর্থক খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কাকলী খীসা বলেন, তিনি নিজেও আতংকে দিন পার করছেন। তিনি বলেন, তাঁর বাবাকেও মোবাইল ফোনে এলাকা ছাড়তে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

মহালছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমা পাহাড়ি লোকজনকে তাদের নিজ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার ঘটনাকে অনভিপ্রেত ও অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমি নিজেও অসহায়। আপাতত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলেও স্থায়ী সমাধান যে কবে হবে তা নিয়ে আমিই হতাশ।

জেএসএস(এমএন) দীঘিনালা উপজেলা শাখার সদস্য সমির চাকমা অভিযোগ করে বলেন, প্রসীতের ইউপিডিএফ’র সন্ত্রাসীরা ভিন্ন সংগঠনের পরিবারগুলোকে বৈসাবি পালন করতে দেওয়া হয়নি। বৈসাবির দিন থেকেই শুরু করা হয় তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়নের।

খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম এম সালাহউদ্দিন বলেন, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। যেখানে ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌছে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

তবে এ সব অভিযোগকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা দাবি করেছেন প্রসীতের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক মাইকেল চাকমা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এটা সাজানো নাটক মাত্র। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সহযোগিতায় মুখোশবাহিনী পুরো জেলায় অরাজকতা চালাচ্ছে। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন