পাহাড়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি: শান্তির পথ কোথায়

ইউসুফ শরীফ
ইউসুফ শরীফ :
তিন পার্বত্য জেলায় জুম ফসল তোলার মওসুম চলছে। এই মওসুম পাহাড়ি মানুষের জন্য আশা ও আনন্দের। তাদের এই আনন্দের সময় উদ্বেগ-শংকা দেখা দিয়েছে। তারা যখন জুমের ধান কাটছেন, তখন পাহাড়ি চাঁদাবাজরা ধানসহ সব ধরনের ফল-ফসল-সব্জির জন্য ‘বাধ্যতামূলক’ চাঁদা আদায় করছে। কৃষকদের মনে শান্তি নেই। আগামী দিনগুলো যেন অনিশ্চয়তায় ভরা। পার্বত্য জেলাগুলোতে চাঁদাবাজি কোন নতুন বিষয় নয়। এই তিন জেলায় গুম-অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়, খুন-খারাবি, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধের পাশাপাশি চাঁদাবাজিও চলে আসছে।
দৈনিক ইনকিলাব-এ প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরে আরও বলা হয়েছে, শুধু ফল-ফসলই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, খামার, ঠিকাদারি, উন্নয়নমূলক কাজেও চাঁদাবাজি চলছে। এমন অভিযোগ রয়েছে যে, চাঁদাবাজির নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। উপজাতি-বাঙালি নির্বিশেষে এই তিন জেলার নিরীহ লোকজন চাঁদাবাজদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, নামে-বেনামে প্রায় একডজন সন্ত্রাসী সংগঠন, গ্রুপ কিংবা দলছুট গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে কমবেশি সক্রিয়। পাহাড়ি সন্ত্রাসী এসব গ্রুপ চাঁদাবাজির মাধ্যমে দিনে আদায় করছে এক থেকে দেড় কোটি টাকা।
পার্বত্য তিন জেলায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য সাধারণ মানুষদের জন্য আতংক সৃষ্টি করছে। শুধু চাঁদাবাজি নয়, অপহরণ, খুনও আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষরা ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন-এমন খবর গত জুন মাসেও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। আগের পাঁচ মাসে খুন হয়েছেন ৩৫ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ৬০ জন। ওই খবরে প্রকাশ-‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর জানান, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষায় খুবই আন্তরিক। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটাচ্ছে, তা আমাদের সকলকে বিব্রত করছে। পাহাড়ে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি নিয়ে যে অভিযোগ আসছে, তা সরকার শক্ত হাতে দমনের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, পাহাড়ের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়। এ পাহাড়ের মানুষরা কখনই অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি চায় না। পাহাড়ের মুষ্টিমেয় আঞ্চলিক সংগঠন পাহাড়ের বিভিন্ন সমস্যা জিইয়ে রেখেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।’
তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যেও যথেষ্ট স্পষ্ট। ওই খবরের পর তিন মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। পরিস্থিতির কোন উন্নতি যে লক্ষ্য  করা যাচ্ছে না, তা গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক খবরেও জানা গেছে। বাস্তব অবস্থা ও এর সূত্র-উৎস বোঝার জন্য ওই খবরটি থেকেও কিছু অংশ উদ্ধৃত করতে হয়। এতে বলা হয়েছে-‘শান্তিচুক্তির পর জেএসএস ও ইউপিডিএফ নিজেদের মধ্যে হানাহানি, খুন, অপহরণ, গুম ছাড়াও বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে আছে। চাঁদাবাজি এখন অসহনীয় পর্যায়ে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের  বৈঠকে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্বেগজনক চাঁদাবাজির ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। শান্তিচুক্তির আগে পাহাড়ি-বাঙালিদের শুধু চাঁদা দিতে হত শান্তিবাহিনী সদস্যদের অর্থাৎ জনসংহতি সমিতিকে। এখন দিতে হচ্ছে ইউপিডিএফকে। এছাড়া বিভিন্ন উপ-গ্রুপের সদস্যদেরও চাঁদা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এক গ্রুপকে চাঁদা দিলে আরেক গ্রুপ হামলে পড়ে। এতে অতিষ্ঠ পাহাড়ের বাঙালি-পাহাড়ি শান্তিপ্রিয় মানুষ। ইউপিডিএফসহ বিভিন্ন উপ-গ্রুপ চাঁদার টাকা আদায় করছে রীতিমত রসিদ দিয়ে। চাঁদাবাজির অর্থে এরা কিনছে নিত্যনতুন অস্ত্রশস্ত্র। ক্যাডার পর্যায়ে সশস্ত্র সদস্যদের বেতন-ভাতাও দেয়া হচ্ছে। সামান্য জুম চাষী থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, উন্নয়ন ঠিকাদার, পরিবহন খাত, এনজিও ও ছোটবড় সব ধরনের ব্যবসায়ীরা চাঁদার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।’॥ দুই ॥
ইনকিলাব-এ প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে চাঁদাবাজির শীর্ষে রয়েছে শান্তিচুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপল ডোমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপরের অবস্থানে রয়েছে চুক্তির সমর্থক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ক্যাডাররা। এদের অঙ্গ সংগঠন যেমন- পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইম্যান ফেডারেশন বিভিন্ন অপকৌশলে পাহাড়ে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি, বিলুপ্ত ঘোষিত তথাকথিত ‘শান্তিবাহিনী’র দলছুট বিভিন্ন গ্রুপ এবং এর পাশাপাশি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে-বেনামে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি করছে।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য আছে এ খবরে। দুর্গম পাহাড়ে খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কোনরকম চাঁদা বা ‘ট্যাক্স’ আদায় করে না। এমনকি কোনরকম বাধা-বিপত্তিও এক্ষেত্রে নেই। মিশনারি কর্মকা- দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘেœ চলছে। পিতৃপুরুষের ধর্ম-কৃষ্টি হারিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতির অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। এটা একটা কঠিন রহস্যই বটে! পিতৃপুরুষের ধর্ম-কৃষ্টি হারানো-ধর্মান্তরিতকরণ চাঁদাবাজদের কাছে চাঁদাবাজির  মোক্ষম কোন  অজুহাত হতে পারছে না। অথচ পার্বত্য তিন জেলায় সাধারণ মানুষ, যারা কোনই সমস্যা-সংকট সৃষ্টি না করে নিছক বেঁচে থাকার জন্য জুমচাষ ও ফল-ফসল উৎপাদন করছে, তাদের শিকার হতে হচ্ছে বেপরোয়া চাঁদাবাজির। শান্তি প্রতিষ্ঠার কি অদ্ভুত বাতাবরণ!
জুম ফসল তোলার এই মওসুমে চাঁদাবাজি সীমিত থাকে, তা নয়। পাহাড়ে চাঁদাবাজির খবর প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হয়ে থাকে। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা নিজেরা কোন কারণেই অশান্তি সৃষ্টি হোক, এমন কোন কাজে লিপ্ত হন না। চাঁদাবাজরাই সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করছে, পাহাড়ে অশান্তির আবাদ করে চলেছে। যারা শান্তিচুক্তির কথা বলেন, তাদের কি এই চাঁদাবাজ বা শান্তিভঙ্গকারীদের ব্যাপারে কিছুই করার নেই। সরকার যদি এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তখন ওই শান্তিবাদীরাই কি অভিযোগ করবেন না যে, সরকার শান্তিভঙ্গ করছে? পার্বত্য তিন জেলায় শান্তিচুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যারা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন, তারা এ ব্যাপারে কি বলবেন, জানি না। তবে বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস কমবেশি রয়েছে। বিদেশী দাতা সংস্থা, মিশনারিদের লোকজন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ওপর কথিত আদিবাসী তাকমা ইচ্ছামত লাগিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করছে, অশান্তির পথে ঠেলে দিতে চাইছে, তাদের দেশেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস থাকা মোটেই বিচিত্র নয়। তাদের বেলায় কথিত এই মানবাধিকারবাদীরা আদৌ কি কোন ভূমিকা গ্রহণ করছে, না করলে কেন করছে না? এসব প্রশ্নের জবাব বাংলাদেশের মানুষ সঙ্গতকারণেই তাদের কাছে জানতে চাইতে পারে।
বাংলাদেশ গরীব দেশ, বিদেশী সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার দাতাদেশ ও সাহায্য সংস্থাগুলোর হাত অনেক লম্বা। লম্বা হাতের লোকদের তিক্ত সত্য বলা যায় না, তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া যায় না। বাংলাদেশের এই অপারগতার সুযোগ তারা নিচ্ছে। এ সুযোগটা তারা আর কতকাল নিতে থাকবে? এ প্রশ্ন তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষ এবং দেশের অন্যান্য অংশের মানুষের মনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, শান্তিচুক্তি যারা করেছেন, এ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যারা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন, তাদের লোকদেরও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ যখন উঠছে, তখন তারা কি এই অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখার ও প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের গরজ আদৌ অনুভব করছেন? না করলে, তারা শান্তি চান, এটা কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে, আমরা জানি না।॥ তিন ॥
আজ থেকে আটাশ বছর আগে ইনকিলাব-এর সম্পাদকীয় পাতায় আমার কলামে (আদিগন্ত-রাহাগীর) পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দীর্ঘ পরিসরে কিছু কথা লিখেছিলাম। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের এই অঞ্চলে আসার প্রসঙ্গ, যা তাদের রচিত একটি ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, সে কথাই তাতে বেশি করে আলোচিত হয়েছিল। বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত ওই গ্রন্থটি আমাকে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক চাকমা বন্ধু সেই সত্তর দশকের একেবারে গোড়ার দিকে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের ওই গ্রন্থটি চাকমা জাতির ইতিহাসের একটি আকরগ্রন্থ শুধু নয়, ইতিহাস বহুলাংশেই কালানুক্রমিক শৃঙ্খলায় সুবিন্যস্ত করেছেন বিরাজ মোহন দেওয়ান।

বিরাজ মোহন দেওয়ানের ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে অল্প কয়েকটি উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করছি:
‘চাকমা জাতি সম্পর্কে বহু গ্রন্থ পড়িয়া আমার ইহাই ধারণা হইয়াছে যে, চাকমা জাতির গৌরবময় ইতিহাস যদি কিছু থাকে, তাহার অধিকাংশ ব্রহ্মদেশেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেহেতু তথায় চাকমারা একটা বিশিষ্ট জাতিরূপে পাঁচ শতাব্দীরও অধিককাল রাজত্ব করিয়াছিলেন।’
‘ইতিহাসের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে চাকমাদের বেলায় ইহার ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে যেহেতু চাকমারা এই জেলার আদিবাসী নহে এবং চতুর্দশ খৃষ্টাব্দেই তাঁহারা প্রথমে সুলতানের সুনজরে বাঙ্গালায় প্রবেশ করেন। কাজেই তাহাদের প্রাচীন ঘটনাগুলি ব্রহ্মদেশ ও আসামের সাথেই জড়িত।’
আজ যারা ‘আদিবাসী’ বলে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে দুরন্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তাদের বাস্তবতা ও ইতিহাস জানার ও বোঝার দরকার আছে। আর এ জন্য বিরাজ মোহন দেওয়ানের ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটি পাঠ করা দরকার। এ ধরনের আরও যেসব গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলোও পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। বিদেশী প্ররোচনামূলক মতলবি বক্তব্যের সঙ্গে তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও এ অঞ্চলে অবস্থানগত বাস্তবতার মিল আদৌ আছে কি না, এই প্রশ্নটি তাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। নিখাঁদ বাস্তবতা বোঝা ও শান্তির পথে আসার জন্যই এই বিষয়টি তাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তা না হলে তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজটিও দুরূহ করে তোলা হবে। আর তার দায়-দায়িত্ব আলোচ্য গ্রুপগুলোকে বহন করতে হবে।
ইউসুফ শরীফ: সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক
           সৌজন্যে- দৈনিক ইনকিলাব।
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন