পাহাড়ে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা : বিনিয়োগ ও পর্যটকদের নিরাপত্তা জরুরি

সাজেক১

মনির হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে:
পর্যটনের অপার সম্ভাবনা দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, দৃষ্টিনন্দন পাহাড় এবং সবুজের সমারোহে প্রাণ জুড়িয়ে ভ্রমণপিপাসুদের। সাজেক ও নীলগিরিতে দেশ হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায় মেঘ। এসব কারণেই তিন জেলায় পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদ এবং স্থানীয়রা বলছেন, এ অঞ্চলটি হতে পারে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। আর এ জন্য সরকারিভাবে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের মতে, এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এ খাত তিন জেলা থেকেই বছরে ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব।

স্থানীয়রা আরও বলছেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কারণে বতর্মানে এখানে পর্যটক আসতে ভয় পায়। এ ছাড়া পাহাড়ি সংগঠন জেএসএস এবং ইউপিডিএফ পর্যটনবিরোধী বিভিন্ন লিফলেটও বিতরণ করছে।

জানতে চাইলে পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, এ এলাকায় পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের বিশাল সম্পদ এই তিন জেলা। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে পর্যটকরা আসতে চায় না। উপজাতিদের সংগঠন জেএসএস এবং ইউপিডিএফ এভাবে চাঁদাবাজি করছে। তিনি বলেন, শুধু পর্যটন নয়, প্রত্যেকটি সেক্টর থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়। শুধু বাঙালিরাই নয়, পাহাড়িরাও সন্ত্রাসীদের চাঁদা দেয়।

তার মতে, পাহাড়িদের কাছে বিভিন্ন ধরনের ভারি অস্ত্র আছে। পুলিশও সারাক্ষণ অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের ভয়ে থাকে। এ সব সন্ত্রাসী একমাত্র সেনাবাহিনী ছাড়া পাহাড়ের কাউকে ভয় পায় না। সরকারের পক্ষ থেকেও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। চিনু বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি, আমাদের চাঁদাবাজ ও অস্ত্রবাজদের হাত থেকে বাঁচান।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, পর্যটক বাড়াতে হলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজি বন্ধ করা জরুরি। তিনি বলেন, পর্যটনকে ভালোভাবে বিকশিত করতে পারলে আমরা পাহাড়ের পর্যটন থেকে সরকারের জাতীয় রাজস্ব খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারি। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসী পর্যটকদের পকেট হাতিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে নেয়। চুরি, সন্ত্রাসীর কারণে পর্যটন বিকশিত হচ্ছে না।

জানা গেছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ও গাছপালা বেষ্টিত মনোরম দৃশ্যের এ ভূমিতে রয়েছে বাঙালি ও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। পর্যটনের জন্য রয়েছে পাহাড়ে বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর জন্য তা আজ ভূলুণ্ঠিত বলে অনেকেই আক্ষেপ করেন।

অশান্ত পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। জেএসএসের (সন্তু লারমা) সঙ্গে করা এ চুক্তি এরই মধ্যে পার করেছে সাড়ে ১৮ বছর। চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে, পাহাড়িদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। কিন্তু ওই চুক্তি ভঙ্গ করে তারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে পূরণ করা হয়েছে চুক্তির বেশিরভাগ শর্ত।

কিন্তু পাহাড়ে হানাহানি বন্ধে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল তা বন্ধ করেনি এই অঞ্চলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্র“পগুলো। পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি এখনও বন্ধ হয়নি। পাহাড়ে পর্যটনের যে সম্ভাবনা রয়েছে তা কোনোভাবেই কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা সন্ত্রাস। এমনকি পর্যটকদের আগমন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীরা হামলা চালাচ্ছে, আর চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ।

অন্যদিকে, পর্যটন নিয়ে চালানো হচ্ছে নানা অপপ্রচার। পর্যটকদের এখনও সেনা-পুলিশের পাহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় পাহাড়ে। অপরদিকে, এই এলাকায় যাতে পর্যটকরা না আসেন সে জন্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বছরজুড়ে চালানো হয় নানা অপপ্রচার।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য এলাকায় বেশকিছু পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এ সব পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান ও যানবহন ব্যবস্থাপনায় শত শত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই পাহাড়ি। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও অনগ্রসর কৃষি পদ্ধতির জুম চাষ ছিল যাদের একমাত্র আয়ের উৎস।

পর্যটক আকৃষ্ট এসব অঞ্চলকে অশান্ত করতে দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা নানাভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এসব পর্যটন কেন্দ্রে মানুষের আগমনে সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারে বাধার সৃষ্টি হওয়ায় পার্বত্য এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিরুদ্ধে পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো নানাভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে স্থানীয়রা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন। তারা কঠোর হস্তে সন্ত্রাসীদের দমন করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন জেলার পর্যটন খাতের উন্নয়নে সম্প্রতি সদর ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার তিন মৌজার ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ইকোনোমিক জোন অথরিটির মাধ্যমে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এ সব এলাকার উপজাতিদের উচ্ছেদ আতংকে পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো এ নিয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে আসছে।

এ জন্য বর্তমানে এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এসএম শফি বলেন, আলুটিলা ইকোট্যুরিজম পর্যটনসহ বিভিন্ন স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আলুটিলা থেকে কোনো বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ছাড়াই সেখানে ইকোট্যুরিজম তৈরি করা যাবে। কিন্তু একটি মহল এ পর্যটনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

জানা গেছে, সাজেক, কাপ্তাই ও পাবর্ত্য এলাকায় যাতে পর্যটকরা না আসে এ জন্য পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় পর্যটনবিরোধী পোস্টার লাগানো হয়েছে। অপপ্রচার করা হচ্ছে পর্যটনের নামে নাকি স্থানীয় উপজাতিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পর্যটকদের ভয়ভীতি দেখানো হয়, বিভিন্ন হোস্টেল ও রিসোর্টের মালিকদের কাছ থেকে উচ্চ হারে চাঁদা আদায় করা হয়। এমনকি বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়।

বাংলার দার্জিলিং খ্যাত সাজেক পর্যটন কেন্দ্র্রে দর্শনার্থীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে এখানে থাকার জন্য কক্ষ পাওয়া যায় না। আগে থেকেই বুকিং হয়ে যায়। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া এক হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। সরকারি রিসোর্টের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অনেক বেসরকারি রিসোর্ট, হোটেল। ছয় মাস আগে যেগুলো একতলা ছিল সেগুলো এখন দোতলা হয়ে গেছে। এ পর্যটন কেন্দ্র্রটি ব্যাপকভাবে বদলিয়ে দিয়েছে স্থানীয় পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন পদ্ধতি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন