পাহাড়ে আর্মি পাহাড়ীদের চক্ষুশুল কেন?

মেজর জেনারেল আ. ল. ম. ফজলুর রহমান

সেই ১৯৭৫ সাল থেকে আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিযানে নিয়োজিত । ১৯৭৭ সালে প্রথম শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ আর্মি কনভয়ের উপরে আক্রমণ চালায়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ( এম এন লারমা ) নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি ( পিসিজেএসএস ) গঠিত হয়। ১৯৭২ সালেই এম এন লারমা পিসিজেএস এর সশস্ত্র শাখা হিসাবে ষ্টাফ ব্যাটলারস ( এস বি ) গঠন করেন যা পরে শান্তিবাহিনী নাম পায়।

সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা, বংগবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের বাঙালী হতে বলেন এবং পাহাড়ীদের স্বায়ত্ব শাসনের দাবী না মানার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও অশান্ত হয়ে আছে। আমি এই ধারণার সাথে একমত নই।

বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের বাঙালী হতে বললেন আর পাহাড়ীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু করে দিলো- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রাঙামাটির বর্তমান রাজা ব্যারিস্টার দেবাষিশ রায়ের পিতা রাজা ত্রিদিব রায় ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের সহায়তা প্রদান করেন। তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিরোধী একটি গোষ্ঠি সক্রিয় থেকে যায়। যার পুর্ণ সুযোগ প্রতিবেশী দেশ গ্রহণ করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে দুর্বল করে সুবিধা আদায়ের সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরই ফলশ্রুতিতে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ( পিসিজেএসএস ) এবং শান্তিবাহিনী।

প্রশ্ন হলো, প্রতিবেশী দেশ এম এন লারমা এবং তার ভাই সন্তু লারমাকে দিয়ে পিসিজেএসএস এবং শান্তিবাহিনী গঠনে সর্বপ্রকার সহায়তা কেন দিয়েছিলো? এর জবাব পেতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে।

১৯৪৭ এ স্বাধীনতা লাভের পরে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। কাশ্মীর নিয়ে উভয় দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান আর একদফা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ভারত-পাকিস্তান একে অপরের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লাগে।

তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান ভারতের সাত বোন খ্যাত রাজ্যসমুহের অশান্ত গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জংগলে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে এবং অন্যান্য সহায়তাও অব্যাহত রাখে। ফলে মিজোরামের গেরিলা নেতা লালডেঙ্গা এবং নাগাল্যান্ডের ড. ফিজো অপ্রতিরোধ্য হয় ওঠে ফলে প্রতিবেশী দেশের পক্ষে সাত রাজ্যের গেরিলাদের দমন করা অসম্ভব হয় পড়ে।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে প্রতিবেশী দেশের জন্য সাত রাজ্যের গেরিলা যোদ্ধাদের পরাজিত করার একটা চমৎকার সুযোগের সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশী দেশ রাজা ত্রিদিব রায়ের সংক্ষুব্ধ অনুসারীদের দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেঃ

১। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করে প্রতিবেশী দেশের গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিপদসঙ্কুল করে তোলা।

২। প্রতিবেশী দেশ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সৃষ্টি করে তাদের এক্সটেন্ডেড সিকিউরিটি হ্যান্ড হিসাবে যাতে শান্তিবাহিনীর সাহায্যে প্রতিবেশী দেশের সাত রাজ্যের গেরিলাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় এবং জংগল থেকে তাদের ঝেটিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এতে প্রতিবেশী দেশ কৃতকার্য হয় এবং সাত রাজ্যের গেরিলাদের দমনে সক্ষম হয়।

এর ফলশ্রুতিতে লালডেঙ্গা এবং নাগাল্যান্ডের ড. ফিজো প্রতিবেশী দেশের সাথে শান্তি স্হাপনে বাধ্য হয়। আজও প্রতিবেশী দেশের সাত রাজ্যে গেরিলা যুদ্ধ পুনরায় মাথাচাড়া দিতে সক্ষম হয় নাই। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে পিসিজেএসএস এবং শান্তিবাহিনীর প্রতিবেশী দেশবান্ধব তৎপরতা।

৩। পার্বত্য চট্টগ্রামে পিসিজেএসএস এবং শান্তিবাহিনী সৃষ্টি করে বাংলাদেশের বুক চিরে রক্তক্ষরণ নিশ্চিত করা যাতে বাংলাদেশে অশান্তির আগুন প্রজ্বলিত রেখে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা সম্ভব হয় । কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। পার্বত্য চট্টগ্রামের লাইফ ব্যাটেল গ্রাউন্ডে প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতায় সিক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে তানয় জাতিসংঘের হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত এখন বাংলাদেশের গর্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

প্রশ্ন হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে কি শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে? পিসিজেএসএস সরকারের সাথে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে এর কৃতিত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আমার দৃঢ় ধারণা শান্তিবাহিনীর একটি অংশ ইউপিডিএফ নামে পিসিজেএসএস এর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ইউপিডিএফ এর এখন বড় কাজ হচ্ছে পাহাড়ে চাঁদা আদায় করা এবং প্রতিবেশী দেশের প্ররোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করা। এরও অবসান কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি বলবো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের বিজয় অর্জিত হয়েছে যার মুল কুশীলব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই বিজয় প্রতিবেশী কোনো দেশের পক্ষে তাদের দেশের গেরিলা যুদ্ধের উপরে অর্জন করা সম্ভব হয়নি যা বাংলাদেশ করেছে।

১৯৭৮- ৮০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংগালীদের পুনর্বাসন হয়। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। গেরিলা যুদ্ধ সংকুল সব স্হানে সব দেশ স্ব-স্বদেশের নাগরিকদের পুনর্বাসন করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংগালীদের পুনর্বাসনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। বাংগালীদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ীদের মাঝে নবউন্নয়নের ধারণার সূচনা হয়েছে।

এখন না হলেও ভবিষ্যতে পাহাড়ী বাংগালী মিলে পুর্ণ শান্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে একে অপরের সম্পূরক হিসাবে নিজেদের নিয়োজিত করবে। একটা জাতির উত্তরণ ঘটাতে হলে অভিজ্ঞতার অন্ত আদান প্রদানের কোনো বিকল্প নাই।

পাহাড়ে বাংগালীরা পাহাড়ীদের জন্য সেই কাজটাই করছে। আজ পাহাড়ীদের অনেকে জুম চাষ বাদ দিয়ে অন্য জীবিকার চিন্তা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক স্হান এখন পর্যটন এবং হর্টিকালচারের হাব হিসাবে গড়ে উঠছে। আমি নিজে আশির দশকে তিনবার পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পদাতিক ব্যটালিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব পালনের সময় দেখেছি কিভাবে পাহাড়ের পর পাহাড় ধ্বংস হয়েছে জ্যুম চাষের ফলে।

একটি পাহাড়ে পর পর কয়েকবার জুম চাষ করলে তা বন্ধা বা রাইন্যা হয়ে যায়। ঐ পাহাড়ে কোনো প্রকার গাছপালা জন্মে না। সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে।

আশির দশকে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে সবখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিলো তখন পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিলো। পাহাড়ী বাংগালী নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিলো। ’৯৭ তে শান্তি চুক্তির পরে অস্হায়ী সেনা ক্যাম্প উঠে যাবার পরে উজাড় হচ্ছে যেমন পাহাড়ী বন তেমনি পাহাড়ময় ছড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাস। এখন কারো নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। এটাই পাহাড়ে সন্ত্রাস যারা চায় তাদের মুল লক্ষ্য।

পাহাড়ী এবং কিছু বাংগালী বুদ্ধিজীবী তারস্বরে চিৎকার করে সেনা শাসনের অবসানের কথা বলে। তারা চায় বাংগালীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সমতলে চলে আসুক। কিন্তু তারা নিজেরা জানে না, সেনা শাসন বলতে কি বুঝায়? পার্বত্য চট্টগ্রামে সিভিল প্রশাসন আছে তারা তা পরিচালিত করে। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর কাজ হলোঃ

১। সন্ত্রাস দমন করা।

২। পাহাড়ী-বাংগালী নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৩। শান্তকরণ ( পেসিফিকেশন ) কার্যক্রম পরিচালিত করা।

এখানে সেনা শাসনের প্রশ্ন কি করে আসে? পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র রক্ষা করতে হলে প্রত্যেকটি অস্হায়ী সেনা ক্যাম্প পুনর্জীবিত করে সত্ত্বর সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণের ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে সরকারকে গ্রহণ করার জন্য আমরা অনুরোধ করছি। যদি তা করা না হয় তবে পরিস্থিতির চরম অবনতি হলে পাহাড়ে নতুন করে সন্ত্রাসের উম্মেষ ঘটার সম্ভাবনা প্রকট হবে যা যা পাহাড়ী, বাংগালী কারুর জন্য কাম্য হবে না।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রাইফেলস ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

2 Replies to “পাহাড়ে আর্মি পাহাড়ীদের চক্ষুশুল কেন?”

  1. পার্বত্য চট্রগ্রামে সেনাবাহীনির কোন বিকল্প নেই।কিছু বাঙ্গালী উপজাতীর দালাল নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে উপজাতীদের পক্ষ নিচ্ছে!!! কারন এরা কোন একসময়ে এই অঞ্চলে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই।আর উপজাতীর স্বপ্ন হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্য ল্যান্ড নামে আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা!!!!

  2. যত দিন সেনাবাহিনী পাহাড়ে থাকবে ততদিন পাহাড় বাংলাদেশের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন