পার্বত্য সংকট ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ প্রসঙ্গ

sayed

♦ সৈয়দ ইবনে রহমত
গত ১৮ মার্চ ২০১৫ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দ্রুত রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজে ক্লাস শুরুর নির্দেশ দেন। একই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের পরিচালনা বোর্ডে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) একজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এবং ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় উপজাতি কোটা বাড়ানো হবে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ প্রকাশের পরদিন রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখে ওই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বণ্টন করে দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন।

এর আগেও (গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) স্বাস্থ্যমন্ত্রী দ্রুত রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের ক্লাস শুরুর উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রীর সে নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। ঊষাতন তালুকদারের এই নেতিবাচক বিবৃতি পড়ার পর ধারণা করি, এবারও তা বাস্তবায়িত হবে না। অথচ, রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। কিন্তু রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ চালু না করার দাবিতে তিনি যে বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন তা ব্যক্তি ঊষাতন তালুকদারের নামের সাথে একেবারেই বেমানান। কারণ তার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ এবং জনপ্রতিনিধি কখনোই এমনভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন না।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ

গত ১০ জানুয়ারি ২০১৫ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সারাদেশের মতো পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীদের সন্তানদের শিক্ষার জন্যই এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর যাদের ভোটে ঊষাতন তালুকদার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, প্রধানত তাদের ছেলে-মেয়েরাই এখানে পড়ালেখার সুযোগ পাবেন। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে এই রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজে ছাত্র ভর্তির সুপারিশ করে এর আগে ডিও লেটার দিয়েছেন। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তারপরও তিনি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের আবেগ এবং প্রাণের দাবির বিরুদ্ধে, এমনকি নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে এমন একটি বিবৃতি কেন দিলেন?

উপরের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। ব্যক্তি ঊষাতন তালুকদার আরও একটি পরিচয় বহন করছেন এবং সেই পরিচয়ের কারণেই তিনি আজ সংসদ সদস্য। আর সে পরিচয়টি হলো, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ-সভাপতি। তাই তিনি নিজে যতই শিক্ষানুরাগী হোন না কেন, জেএসএসের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর সন্তু লারমার সিদ্ধান্তই হলো জেএসএসের সিদ্ধান্ত। এটাও জানা যে, শুধু রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ নয়, বরং রাঙ্গামাটি বিশ^বিদ্যালয়সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় যাবতীয় উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা। তার দাবি, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না-হওয়া পর্যন্ত রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজসহ সকল প্রকার উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ রাখা। যদিও সরকারের ভাষ্য, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্টগুলোও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু সরকারের কথায় কোনোভাবেই কর্ণপাত করতে তিনি রাজি নন। সে কারণেই ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার পর ১৫ বছর পার হয়ে গেলেও সরকার তা কার্যকর করতে পারেনি। আসলে বাস্তবতা যা দাঁড়িয়েছে সেটা চলতে থাকলে আরও ১৫ বছর পার হয়ে গেলেও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।

বর্তমান অবস্থায় সন্তু লারমার পক্ষে স্বাভাবিক এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবও নয়; কারণ, তিনি নিজেই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের পর ১৯৯৯ সালের ১২ মে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করে আজ পর্যন্ত একই পদে অধিষ্ঠিত আছেন। সামনের মে মাসে তিনি ক্ষমতার ১৬ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছেন। আরও কতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন তারও কোনো সীমা নির্ধারিত নেই। যা কোনো আইন এবং নৈতিকতার গণ্ডির মধ্যে পড়ে না। কোনো প্রকার জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতাও তার নেই। কারণ তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন, বরং সরকারের কৃপায় নিয়োগকৃত। তবে ধারণা করা হয়, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়ে গেলে তিনি আর আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান না-ও থাকতে পারেন। কারণ, তখন আর সরকারের নিয়োগকৃত চেয়ারম্যান হিসেবে থাকার সুযোগ থাকবে না, বরং নির্বাচন করে জিততে হবে। কিন্তু তার যে জনপ্রিয়তা তাতে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এ কারণেই আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন সময় বলে থাকেন, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না-হওয়াই বরং সন্তু লারমার জন্য ভালো। তিনি নিশ্চিন্তে সরকারি বাড়ি, গাড়ি, এসির বাতাস এবং নিরাপত্তাসহ আজীবন ক্ষমতা ভোগ করে যেতে পারবেন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি এমন প্যাঁচ কষে রেখেছেন যাতে কোনোভাবেই পার্বত্য ভূমি সমস্যার সমাধান না হয় এবং একই সাথে পার্বত্যবাসীর ভোটাধিকারের বিষয়টিরও ফয়সালা করা না যায়। সমস্যাকে আরও জটিল করার জন্য তিনি পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে নতুন করে হুমকি-ধামকিও দিয়ে আসছেন। সরকারকে আগামী ৩০ এপ্রিল ২০১৫-এর মধ্যে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আল্টিমেটামসহ হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন যে, তা না-হলে ১ মে ২০১৫ থেকে তিনি আবার পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বের মতো অসহযোগ (সশস্ত্র) আন্দোলন শুরু করবেন।

এ অবস্থায় সকলেই হয়তো পার্বত্য সমস্যা জটিলতর হওয়া এবং কোনোদিনই রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না-হওয়ার ব্যাপারে হতাশাবোধ করবেন। তবে এটাই যে শেষ বাস্তবতা নয়, তা অনুধাবনের জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। যেমন ১৯৯৭ সালে চুক্তি করার বিষয়ে সন্তু লারমারা স্বেচ্ছায় রাজি হননি। তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত সুধা সিন্ধু খীসা তার আত্মীয় শরদিন্দু শেখর চাকমার (যিনি এসএস চাকমা নামেও পরিচিত) কাছে এটা স্বীকারও করেছিলেন। এসএস চাকমার এক প্রশ্নের জবাবে খীসা বলেছিলেন, আসলে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরে তারা বাধ্য হয়েছেন। কারণ, যে স্বপ্ন দেখিয়ে তারা উপজাতীয় তরুণদের শান্তিবাহিনীতে নিয়োগ করেছিলেন সেটা বাস্তবায়ন ক্রমেই সুদূরপরাহত হয়ে উঠছিল। তাই সেইসব তরুণরা হতাশ হয়ে পড়ছিল। আর সে কারণেই তারা চুক্তি করে কোনো মতে মুখ রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। আরও একটি উদাহরণ এখানে টানা যায়, ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর সরকার সন্তু লারমাকে চেয়ারম্যান করে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করলেও নানা দাবি-দাওয়া তুলে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন, সম্ভবত তার ওপর সেরকম চাপও ছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের তখনকার বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে জানা যায়, নানা রকম দাবির কারণে সরকার অতিষ্ঠ হয়ে সন্তু লারমাকে বাদ রেখে অন্যদের দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করা শুরু করে। আর সেটি আঁচ করতে পেরেই সন্তু লারমা দ্রুত ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ১৯৯৯ সালের ১২ মে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি তা গ্রহণ করেন।

উপরের দুটি ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে সন্তু লারমার পক্ষে জনকল্যাণমূলক কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। সশস্ত্র আন্দোলন করে এসে দায়বদ্ধতা বিহীন দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একজন নেতার পক্ষে যা খুব স্বাভাবিকও বটে। তাছাড়া দেশের বাইরের এবং ভেতরের অনেক কালপ্রিটের উসকানি এবং ইন্ধন তো রয়েছেই। সে কারণে বিশেষ পরিস্থিতি এবং পরিবেশ পেলেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া তার জন্য সহজ হয়। এই অবস্থাতেও অর্থাৎ রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর পক্ষে সন্তু লারমাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারকে পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন করা যেতে পারে। একই সাথে পার্বত্য চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে করা যে মামলাটি আপিল বিভাগের বিবেচনাধীন রয়েছে সেটি দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আপিল বিভাগের রায় পেলে সে রায় অনুযায়ী পার্বত্য চুক্তিকে পুনর্মূল্যায়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি সাময়িকভাবে আরও কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন, দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি কোটা আছে। এসব কোটা সুবিধায় প্রতি বছর শত শত উপজাতীয় তরুণ-তরুণী যোগ্য না-হয়েও উচ্চ শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। সে কারণে রাঙ্গামাটিতে মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না-হলেও সন্তু লারমা উপজাতীয়দের উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন। তাই আপাতত সকল বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান উপজাতীয় কোটা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে যে, দীর্ঘদিন কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখা ঠিক নয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যাপারে যেমনটি ভাবা হচ্ছে। তাছাড়া উপজাতীয়রা এখন দেশের মূল জনগোষ্ঠী বাঙালিদের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

সরকার উপরের পদক্ষেপগুলো নিলেই আশা করা যায়, রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সন্তু লারমাদের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হবে। এমনকি একই প্রক্রিয়ায় পার্বত্য সমস্যা সমাধানে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। আশা করি, এই পথেই পার্বত্য পরিস্থিতিতে যে কৃত্রিম শান্তি বর্তমানে বিরাজমান আছে, তা স্থায়ী শান্তিতে পরিণত হতে পারবে।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন