পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ থেকে সরে আসা যাবে না

fec-image

মুক্তমত

মনসুর হায়দার:

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশী অর্থে পুষ্ট ও পরিচালিত এনজিও এবং দেশী-বিদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগ কয়েক দশকের। বছরের পর বছর ধরে তারা পাহাড়ি উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে এবং বাঙালিদের বিপক্ষে বৈষম্য তৈরিতে মদদ দেয়া, পার্বত্য চুক্তি ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা তৈরি, রাজনৈতিক তৎপরতায় অর্থ যোগানো, অস্ত্রপাচার, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণসহ বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

এসবের বিরুদ্ধে এতদিন উদাসীন থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও দেশবিরোধী চক্রান্ত বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় বিদেশী সংস্থা ইউএনডিপি’র কার্যক্রম মনিটরিং ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা, বিদেশী ভ্রমণকারী ও কূটনীতিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর ও স্থানীয় পর্যায়ে বৈঠক নিয়ন্ত্রণ এবং পুলিশ ও আনসারে যোগ দেয়া শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্যদের তিন পার্বত্য জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলীর মতো ১১টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র দমনে সরকারের কঠোর অবস্থান প্রস্ফুটিত হয়েছে।

সভায় স্বরাষ্ট্র সচিব ছাড়াও সভায় পররাষ্ট্র সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, আনসার ভিডিপি’র মহাপরিচালক, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজিবি’র কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলো।
সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খানসহ আরো অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উল্লেখ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের নামে যে অর্থ ব্যয় হয় তার জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি এবং ফলাফল সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।

এছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে ৩ পার্বত্য জেলার পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্যদের বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি গত ১০ বছরে ৩ পার্বত্য জেলার উন্নয়নে ইউএনডিপি যে ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (সাড়ে ১২শ কোটি টাকা) খরচ করেছে তার হিসাবও নেবে।

সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কূটনীতিক ছাড়া সাধারণ বিদেশীদের তিন পার্বত্য জেলায় ভ্রমণ করতে এক মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। মন্ত্রণালয় ওই আবেদনকারীর বিষয়ে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দিতে আবেদনটি দেশের তিন গোয়েন্দা সংস্থায় পাঠাবে। সংশ্লিষ্ট আবেদনের বিষয়ে ইতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদন আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভ্রমণের অনুমতি দেবে। তবে অনুমতিপ্রাপ্ত বিদেশীকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে ভ্রমণ সূচি দাখিল করতে হবে। অন্যদিকে কূটনীতিকদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমতি গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ পার্বত্য জেলার সব প্রবেশপথে চেকপোস্ট আরো সক্রিয় করতেও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সকে চিঠি দিয়েছে।

এছাড়া সভায় জানানো হয়, অনেক সময় বিদেশীরা সরাসরি স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণ করে থাকে। ফলে এ বিষয়টি প্রশাসন কিংবা সেনাবাহিনীর অগোচরেই থেকে যায়। তাই এখন থেকে দেশী-বিদেশী ব্যক্তি এবং সংস্থার প্রতিনিধিরা পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠক করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিচ্ছিন্নতাবাদী পাহাড়িদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা অসংখ্য নামসর্বস্ব এনজিও’কে কথিত উন্নয়ন প্রকল্প বা কর্মসূচির নামে অঢেল অর্থ বরাদ্দ দিয়ে আসছে বিদেশীরা? তারা এ সুবাদে যখন-তখন পার্বত্য অঞ্চল সফর করে আসছে? এতে জনস্বার্থ ও সরকারবিরোধী নানা ধরনের উস্কানিমূলক কর্মকা- ঘটে আসছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। এ কারণে সরকার বিদেশী নাগরিকদের পাহাড়ে ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিন পার্বত্য জেলায় শান্তিচুক্তিবিরোধী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, খুন ও অপহরণের সঙ্গে যুক্ত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসারসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সমন্বিত যৌথ অভিযান পরিচালনা করা এবং সিএইচটি কমিশনের নাম থেকে ‘কমিশন’ শব্দটি বাদ দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সভায়।

সভায় আরো বলা হয়, শান্তিচুক্তি পরবর্তী সময়ে স্থানীয় একাধিক সংগঠন বিভিন্নভাবে শান্তিচুক্তি বিরোধী কার্যক্রমসহ চাঁদাবাজি, অপহরণ ও বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে পাহাড়ি জনপদ ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে। যেসব সংগঠন শান্তিচুক্তিবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত এবং চাঁদাবাজি, হত্যা ও অপহরণের সাথে যুক্ত, যেমন- জেএসএস এবং ইউপিডিএফসহ আরো যে সব স্থানীয় সংগঠন আছে, তাদের কাছে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র আছে। এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হবে।

তাছাড়া প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সবসময়ই সক্রিয় রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার থেকে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য চোরাচালানীতেও কোনো কোনো সংগঠন জড়িত রয়েছে। তাই বিজিবি’র প্রস্তাব অনুযায়ী বিওপি বাড়ানো হবে। বিওপি স্থাপনের জন্য বন বিভাগ থেকে জায়গাও বরাদ্দ দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে ।

উল্লেখ্য, বিদেশী নাগরিক এবং এনজিওসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে পার্বত্য এলাকার অস্থিতিশীলতা খুব দ্রুত কমে আসবে। সিএইচটি কমিশনসহ ১৪৪টি বিদেশী এনজিও মিশনারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এনজিওতে আসা-যাওয়াকারী বেশিরভাগই বিদেশী নাগরিক। তারা উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ বানাতে অতিতৎপর। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে বিতর্কিত সিএইচটি কমিশনসহ এসব এনজিও মিশনারীরা স্থানীয় উপজাতিদের সাথে আলাপ-আলোচনার সময় প্রশাসন কিংবা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি চায় না। ধর্মান্তরকরণসহ পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদে এরা জড়িত।

শুধু তাই নয়; এনজিও’র নামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আড়ালে এসব বিদেশী মিশনারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের ব্যাপকহারে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরের কাজে লিপ্ত। ইউএনডিপি ও এর অঙ্গসংগঠন, ইইউ, ডানিডা, ইউএসএইড ইত্যাদি সংস্থার অর্থায়নে এই ধর্মান্তরকরণ চলছে। চিহ্নিত এনজিওগুলোর মধ্যে খ্রিস্টান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ (সিসিডিবি), অ্যাডভানটেজ ক্রুশ অব বাংলাদেশ, হিউম্যানিট্রেইন ফাউন্ডেশন, ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান ক্রুশ, গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা, শান্তিরানী ক্যাথলিক চার্চ, জাইনপাড়া আশ্রম, গ্রিনহিল, তৈদান, আশার আলো, মহামণি শিশু সদন, কৈনানিয়া, কারিতাস ও তৈমুসহ এনজিওগুলো এসব দেশবিরোধী কাজে জড়িত। উল্লেখ্য, এনজিও ব্যুরো সূত্র মতে, পার্বত্য জেলাসমূহে ১৪৪টি এনজিও, মিশনারী কাজ করছে। তারা পার্বত্য জেলাগুলোয় ৯৫০ গির্জা স্থাপন করেছে।

বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত যথোপযুক্ত এবং বাস্তবসম্মত। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তে বিদেশী স্বার্থ রক্ষাকারী তথাকথিত নাগরিক সমাজের নাম ভাঙ্গানো বাঙালিবিরোধী, পাহাড়ি ও বিদেশীদের দালাল সিএইচটি’র সুলতানা কামাল, ঢাবি’র মেসবাহ কামাল, আবুল মকসুদ, টিআইবি’র ইফতেখার, প্রথম আলো’র মতিসহ ব্যারিস্টার সারা হোসেন নামক দালালদের রীতিমতো গা-জ্বালা শুরু হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে তারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। বিদেশী স্বার্থ রক্ষায় মুখর হলেও দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে তাদের কোনো আওয়াজ নেই।

এদিকে চিহ্নিত গুটিকয়েক বিদেশী দালালদের লাফালাফিতে মন্ত্রণালয় তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের চিন্তা করছে বলে শুনা যাচ্ছে। যদি তাই হয়; তাহলে তা হবে দেশের স্বার্থবিরোধী ও বিদেশী দালালদের কাছে সরকারের আত্মসমর্পণ; যা হবে চরম আত্মঘাতী। যার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা যেখানে জাতিসংঘসহ বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা যুদ্ধাপরাধের বিচার থামাতে পারেনি, চলমান সহিংসতায় সন্ত্রাসীদের সাথে সরকার আপোস না করায় বিদেশীরা কিছুই করতে পারেনি, সেখানে দেশের এক দশমাংশ পার্বত্য অঞ্চলকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্রকারীরাও সরকারকে কিছু করতে পারবে না। বরং গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করলে বর্তমান রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সরকারের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। বিপরীত করলে দায়ভার সরকারের উপরই বর্তাবে।

তাই সরকারের উচিত- দেশের স্বার্থে গৃহীত এসব পদক্ষেপ অতিসত্বর বাস্তবায়ন করা। বিদেশী অর্থে লালিত গুটিকয়েক এনজিও এবং তাদের দালাল সিএইচটি’র সুলতানা কামাল, ঢাবি’র মেসবাহ কামাল, টিআইবি’র ইফতেখার ও মতি গংসহ আবুল মকসুদ, পংকজ ভট্টাচার্য, সারা হোসেন নামক দালালদের চাপে নতিস্বীকার নয়; বরং দেশবিরোধী এসব চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া। খুদকুঁড়া খাওয়া বিদেশী দালালদের সব চক্রান্ত প্রতিহত করতে সরকারের নিজ অবস্থানে সুদৃঢ় থাকা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ থেকে সরে আসা যাবে না”

  1. এখন সরকারেরই উচিত দেশের প্রয়োজনে গ্রহণ করা সিদ্ধান্তের জরুরী বাস্তবায়ন। এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার পিছিয়ে গেলে সেই সব চাটুকারদের বিজয় হবে। যারা বিদেশীদের টাকায় সরকারের রাষ্ট্রিয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্দান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেছে।

    বিদেশী অর্থে লালিত সেসব গুটিকয়েক এনজিও এবং তাদের দালাল সিএইচটি কমিশনসহ তথাকথিত বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবিরা। যাদের কাছে দেশের চেয়ে অর্থ অনেক বড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন