পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১

মেহেদী হাসান পলাশ, Mehadi Hassan Palash

মেহেদী হাসান পলাশ
সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় ‘সার্বভৌমত্ব বিরোধী’ পার্বত্য চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য বাঙালীর মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল ‘আদিবাসী’ বিষয়ে সরকারের কঠোর ও সঠিক অবস্থান সেই ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়েছিল অনেকখানি। কিন্তু গত ৩ জুন হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ সরকার জেএসএস নেতা সন্তু লারমার দাবী পার্বত্য ভ’মি কমিশনের সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করে ক্ষতটি খুচিয়ে আবার রক্তাক্ত করে দিল। ফলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালীরা। ইতোমধ্যে তারা ৫ দিন নজিরবিহীন সফল হরতাল পালন করছে। সামনে আরো কঠিন কর্মসূচী আসছে।

এদিকে বাঙালীদের এই কর্মসূচীর বিরুদ্ধে প্রথমে চুপচাপ থাকলেও ধীরে ধীরে মাঠে নামতে শুরু  করেছে পাহাড়ী বিভিন্ন সংগঠন। ফলে আগামী দিনে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতার শেষ দিকে এসে হঠাৎ করে সরকার কেন এই ধরনের একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিল? পাহাড় সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে ও এর  আওতায় ভূমি কমিশন আইন সংশোধনী অনুমোদন বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় বিভিন্ন পাশ্চাত্যের দেশ, দাতা সংস্থা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রবল চাপ ছিল। ড. ইউনূস, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে কোণঠাসা সরকার পাশ্চাত্যে তার আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা উদ্ধার করতেই ক্ষমতার শেষদিকে এসে এ ধরণের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মধ্যে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তির ঘ খণ্ডের ৪ নং ধারায় প্রত্যাবাসিত উপজাতীয়দের পুনর্বাসনের সহায়তায় তাদের ভূমির মালিকানা ফিরিয়ে দিতে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয় এবং ২ নং ধারায় ‘যথাশীঘ্র সম্ভব ভূমি জরীপ কাজ শুরু’ করার কথা বলা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় এই চুক্তি ও আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাপাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আলোচনার সুবিধার্থে এই আইনের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ধারা উল্লেখ করা হলো:
শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে,
‘জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন(ল্যান্ডকমিশন) গঠিত হইবে। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এ যাবত যেইসব জায়গা জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকিবে। এই কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপীল চলিবে না এবং এই কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে। ফ্রীঞ্জল্যান্ডের(জলে ভাসা জমি) ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে।’
৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমির বৈশিষ্ট বিবেচনায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ভূমি জরীপ সম্পন্ন হওয়া জরুরী ছিল। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার এ বিষয়ে সরকারকে তাগিদ দেয়া হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল আগে ভূমি জরীপ করে ভূমির সীমানা ও মালিকানা নির্ধারণ করার পর বিরোধিত জমির সিদ্ধান্ত ভূমি কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা হোক। কিন্তু উপজাতীয় সংগঠনগুলোর প্রবল বিরোধিতার কারণে ভূমি জরীপ নিষ্পন্ন করা যায়নি। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলে সরকার বিভিন্ন পক্ষের চাপের মুখে ভূমি জরীপ ছাড়াই ২০০১ সালের ১৭ জুলাই ভূমি কমিশন আইন পাস করে। এরপরও ভূমি জরীপ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বা অজুহাতে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

এখানে পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে ভূমি কমিশন আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করা হলো:

‘৩। কমিশনের গঠন : (১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন নামে একটি কমিশন থাকিবে।
(২) নিম্নবর্ণিত সদস্যগণ সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হইবে, যথা :
(ক) বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, যিনি উহার চেয়ারম্যানও হইবেন,
(খ) সার্কেল চীফ (সংশ্লিষ্ট),
(গ) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাহার প্রতিনিধি হিসেবে তৎকর্তৃক মনোনীত উক্ত পরিষদের একজন সদস্য,
(ঘ) সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পদাধিকারবলে,
(ঙ) চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কশিনার বা তৎকর্তৃক মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার।
ব্যাখ্যা : দফা (গ) এবং (ঘ)-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘সংশ্লিষ্ট’ অর্থ বিরোধীয় ভূমি যথাক্রমে যে পার্বত্য জেলা এবং যে সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত সেই পার্বত্য জেলা এবং সেই সার্কেল।
৬। কমিশনের কার্যাবলী ও ক্ষমতা : (১) কমিশনের কার্যাবলী নিম্নরূপ হইবে, যথা :
(ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা,
(খ) আবেদনে উল্লিখিত ভূমিতে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল,
(গ) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন-বহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল :
তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত (Reserved) বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।
১৬। কমিশনের সিদ্ধান্তের আইনগত প্রকৃতি এবং চূড়ান্ত।                                                                    ধারা ৬(১)-এ বর্ণিত কোনো বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট আপিল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।
১৭। কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন।- (১) অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি বা ক্ষেত্রমতো আদেশের ন্যায় উহার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মাধ্যমে বা প্রয়োজনবোধে সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করিতে বা করাইতে পারিবে।’

কিন্তু শুরু থেকেই এই আইনের বিরোধিতা করে আসছিলেন জেএসএস নেতা সন্তু লারমাসহ কিছু উপজাতীয় নেতা। তাদের বিরোধিতার কারণেই সরকার গঠিত চারটি ভূমি কমিশন কার্যকর হতে পারেনি। সন্তু লারমার দাবী, শান্তি চুক্তির একটি লিখিত ফর্ম ও একটি অলিখিত ফর্ম(সাধারণ সমঝোতা) ছিল। তিনি সেভাবেই ভূমি কমিশন সংস্কারের লক্ষ্যে ২৩ দফা সংস্কার প্রস্তাব করেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর ২০১২ সালের ৩০ জুলাই সরকার এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এর ১৩টি প্রস্তাব গ্রহণ করে।
কিন্তু সে সময় পার্বত্য বাঙালীরা এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুললে সরকার সে সংশোধনী অনুমোদন করা থেকে বিরত থাকে। এ ঘটনার প্রায় ৯ মাস পর পার্বত্য সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে নতুন করে এ সংশোধনী অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়। ফলে ২৭ মে মন্ত্রী সভায় সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব ও ৩ জুন চূড়ান্ত প্রস্তাব পাশ করা হয়।

উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ:
ধারা ৬(১)ক : “পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি-জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া জায়গা জমি ও পাহাড়ের মালিকানাস্বত্ত্ব বাতিলকরণসহ সমস্ত ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা।”
 ধারা ৬(১)(গ) : “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:” শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা।
ধারা ৭ এর (৫) : “চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়টিসহ উহার এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করিবেন, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত সম্ভব না হইলে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে;।”
১৩(২) ধারার পরে নতুন উপধারা সংযোজন : “(৩) এই ধারার অধীন কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হইবে।”

এ সংশোধনী পাশের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালীরা হরতাল অবোরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। তাদের দাবী, এই প্রস্তাব পাশ করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীর অবস্থান ও অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এসকল কর্মসূচী সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিপূল স্বতস্ফুতর্তার সাথে পালিত হয়েছে তাতে প্রমাণ করে দলমত নির্বিশেষে পার্বত্য বাঙালীরা কিভাবে দেখছে এই আইনকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের হাইকোর্টে শান্তিচুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রীট দায়ের করা হয়েছিল। দীর্ঘ শুনানীর পর ২০০৯ সালে আদালত সম্পূর্ণ চুক্তিকে বাতিল না করে এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধারাকে বাংলাদেশের সংবিধান, ও সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রিয় অখণ্ডতা বিরোধী বলে তা বাতিল ঘোষণা করে। কিন্তু সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করলে সুপ্রীমকোর্ট আপীল গ্রহণ করে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত ঘোষণা করে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট সূত্রে জানা গিয়েছিল, সেই রীটের শুনানীতে আদালতে ভূমি কমিশন প্রসঙ্গ এলে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়ছিল, এখনো সরকার ভূমি কমিশন বাস্তবায়ন করছেনা বরং ভূমি জরিপের পর কমিশন কাজ করবে। কাজেই এটা নিয়ে এখনই আলোচনার কিছু নেই। এ কথার প্রেক্ষিতে আদালতও যখন ভূমি কমিশন বাস্তবায়ন হবে তখন এ বিষয় নিয়ে ভাবা যাবে বলে মন্তব্য।

পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধনী বিশ্লেষণের আগে  শান্তি চুক্তি ও ভুমি কমিশন আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
১.    শান্তিচুক্তিতে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির কথা বলা হলেও ভূমি কমিশন আইনে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির কথা বলা হয়।
২.    শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ৪ নং ধারায় কেবলমাত্র ‘ পুনর্বাসিত শরণার্থিদের জমি জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি’র কথা বলা হয়েছে। একইভাবে ভূমি কমিশন আইনের ৬(ক) ধারায়ও ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা’র কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী কেবল পুনর্বাসিত শরণার্থিদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এর দায়িত্ব। এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ নেই।
৩. শান্তিচুক্তির ৬(খ). ধারায় বলা হয়েছে, কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন। আবার আইনের ৬(গ) ধারায় বলা হয়েছে,  পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বহির্ভুতভাবে কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল। সংশোধনীতে তা বলা হয়েছে, ধারা ৬(১)(গ) : “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভুতভাবে ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি)সহ কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:” শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা।
অর্থাৎ এই ভূমি কমিশন কাজ করবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। বাংলাদেশর আইন অনুযায়ী নয়। এর সাথে স্থানীয় ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দটিও যুক্ত করা হয়েছে। এখানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন’, ‘রীতি’ ও ‘পদ্ধতি’ শব্দগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, সরকারের কৃর্তৃত্ব ও বাঙালীর অস্তিত্বের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
৪. চুক্তির ঘ খন্ডের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল চলিবেনা’। অন্যদিকে ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘ উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে খর্ব করা হয়েছে।
৫. আইনের ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে।’ দেওয়ানী আদালত একটি সাংবিধানিক আদালত। এর বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান রক্ষায় শপথবদ্ধ থাকেন। অন্যদিকে কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা কেউই শপথবদ্ধ নন। চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হওয়ায় তিনি শপথবদ্ধ নন, আবার বাকি সদস্যরা সাধারণ উপজাতীয়, যারা হয়তো চুক্তির আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এমন কেউ হতে পারেন, অথচ তারা শপথবদ্ধ নন। প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ থেকে যে নামগুলো আসবে তাদের জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র  বর্তমান বা সাবেক ও প্রকাশ্য বা গোপন সদস্য হবার সম্ভাবনাই বেশী।

Email: [email protected]

সৌজন্যে: দৈনিক ইনকিলাব

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে লেখকের আরো কিছু প্রবন্ধ

পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে

একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী

বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক

আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩

   

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী
Facebook Comment

5 Replies to “পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১”

  1. পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ আর বাঙালি মানুষ হলে, দেশে অনেক ব্যবসায়ীর পেটে লাথি পরবে। এটাই তো দেশের বিশাল অর্থনৈতীক বাজার যা পুজি ছাড়া আমার দাদারা ব্যবসায় মুনাফা পাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন