পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের নামে বাংলাদেশ উপজাতি নিমূর্ল অভিযান চালাচ্ছে- এসিএইচআর
হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্ট
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
ভারতভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন এসিএইচআর জাতিসংঘের সফররত স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার লি-র কাছে বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন নীতির কঠোর সমালোচনা করেছে। গ্রুপটি মনে করে, রোহিঙ্গাদের দিয়ে যে ব্যাপকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের ‘নির্মূলকরণ’ চলছে তাতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরো উৎসাহ বোধ করছে।
মিয়ানমার দেখছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকার কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং তারা তাদের বসতি স্থাপন করতে দিচ্ছে। সে কারণে বর্মীরা এখন রাখাইনে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়টি সোমবার হিন্দুস্তান টাইমসে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এই প্রথম।
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের নামে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বৌদ্ধদের উচ্ছেদের মাধ্যমে এথনিক ক্লিনজিং চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে এসিএইচআর। ২০শে ফেব্রুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দিল্লিভিত্তিক একটি মানবাধিকার গ্রুপ এ বিষয়ে বাংলাদেশকে অভিযুক্ত করেছে। এ গ্রুপটি মনে করে, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের দিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জুম্মদের বিতাড়ন করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের যৌথভাবে জুম্ম বলা হয়ে থাকে। জুম্মদের মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরি, চাক, লুসাই, গুরখা, অসমীয় ও বোম রয়েছে।
দিল্লিভিত্তিক এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (এসিএইচআর) রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকট বিষয়ে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি’র কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে জাতিসংঘের র্যাপোর্টিয়ার বাংলাদেশে তার ৪ দিনের সফর শুরু করার আগে তার হাতে এ রিপোার্ট তুলে দেয়া হলো।
হিন্দুস্তান টাইমস ওই মানবাধিকার গ্রুপটির বরাতে উল্লেখ করেছে, ‘৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ধারণ করতে গৃহীত ঢাকার নীতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের বসতি স্থাপন করতে দেয়ার সিদ্ধান্তের ফলে আরাকান প্রদেশ থেকে অধিকতর রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করতেই মিয়ানমার সরকারকে উৎসাহিত করেছে।’
এতে আরো বলা হয়, ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তিন লাখের বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিকে বহিষ্কার করেছে। এসিএইচআর’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯২ সাল থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ইতিমধ্যেই বহিষ্কারের পরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, তাদের পক্ষে অবশিষ্ট সকল রোহিঙ্গাকে বহিষ্কার করা সম্ভব। আর এভাবেই তারা এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে নিতে পারে।’
হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, ১৯৯২ থেকে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু গত ডিসেম্বরে মিয়ানমার আড়াই হাজারের কম সংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিতে রাজি হয়।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অবশ্যই তদন্ত হতে হবে। কিন্তু জাতিসংঘ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের নিজ ভূমিতে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনাকে উপেক্ষা করতে পারে না। রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেয়া হচ্ছে, ‘যারা কিনা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মতোই অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ’।
এসিএইচআর বলেছে, ‘রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বান্দরবন জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এবং তারা আদিবাসী বৌদ্ধদের ভূমি আত্মসাৎ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধভিক্ষুদের ওপর আক্রমণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে বিদ্রোহী তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে।’
ওই মানবাধিকার গ্রুপটির একদল গবেষক গত জানুয়ারিতে কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছে। তখন তারা লক্ষ্য করেন, রোহিঙ্গারা সেখানে অস্থায়ী শিবিরগুলোতে বসবাস করছে। তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নতুন করে আরো আক্রমণ পরিচালিত না হওয়ার কোনো গ্যারান্টি না থাকার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে ফিরে যেতে তাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই।
এসিএইচআর পরিচালক পরিতোষ চাকমা বলেছেন, ‘একই সময়ে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের কোনো নিবন্ধন বা তাদের কোনো পরিচয়পত্র ইস্যু করছে না। অথচ মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্যই তাদের উৎপত্তিস্থলের রেকর্ড রাখা প্রয়োজনীয়। আসলে তাদের প্রত্যাবাসন করতে বাংলাদেশের কোনো মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।’
মি. চাকমা আরো উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালের জুনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত জাতীয় জরিপ নিশ্চিত করেছে যে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের সর্বশেষ আদমশুমারি বলেছে, ১৯৯১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা ১,৫৭,৩০১ থেকে ২০০১ সালে ২,৯৮,১২০-তে উন্নীত হয়েছে। সমগ্র দেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি যেখানে ১৭%, সেখানে একদশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ৯০ ভাগ। আর এ সময়টাতেই রোহিঙ্গারা পার্বত্য জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছে।
মি. চাকমা আরো বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পদ্রায়ের মধ্যে অল্পসংখ্যকই স্বীকার করবেন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা যারা মিয়ানমারে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন, সেই তারাই বান্দরবান জেলায় মার্মা আদিবাসীদের জীবনে প্রকৃত শাসকে পরিণত হয়েছেন। আর এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের ওপরে।’
সূত্র: মানবজমিন