পার্বত্য চট্টগ্রামে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে পরিবর্তন

পাহাড়ি ঘোনায় বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ
Rangamati Fiss News-Pic-02-29.08.2014

নিজস্ব প্রতিনিধি, রাঙামাটি: 
পার্বত্য চট্টগ্রামে মৎস্য চাষ উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণে দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। মৎস্য মন্ত্রনালয়ের অধিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার ২৫টি উপজেলায় দু’পাহাড়ের মাঝে ক্রীকের (ঘোনায় মাছ চাষের জন্য বাধঁ) মাধ্যমে মৎস্য চাষের এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় দু’শ ক্রীক নির্মাণ করা হয়েছে । সৎ উদ্দেশ্য ভাল কর্মকর্তা থাকলে সুফল পাবে পার্বত্য এলাকার মানুষ।আরো প্রায় পাচ শতাধিক ক্রিক নির্মানের জন্য সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।

এসব ক্রিক নির্মাণের ফলে খুব সহসাই পার্বত্য এলাকায় মাছ চাষে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত এবং মাছ চাষের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন। মাছের রেনু এবং পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য রাঙামাটি ও বান্দরবানে ইতিমধ্যে দু’টি মিনি মৎস্য হ্যচারী নির্মাণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে আরো একটি মিনি মৎস্য হ্যাচারী নির্মান করা হবে বলে জানা গেছে।

জুলাই’২০১২- জুন’২০১৭ পর্যন্ত পাচঁ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পে সাড়ে আটষট্রি কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর সুত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দেশের সমতল জেলাগুলোতে পুকুর, নদী,নালা ডোবা থাকলে পার্বত্য এলাকায় কিছু সংখ্যক নদী ছাড়া তেমন কোন নদী,নালা,পুকুর বা ডোবা নেই। পার্বত্য বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কিছু পুকুর ও ডোবা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যন্ত সীমিত।

উপরন্তু কারিগরি এবং আর্থিক সমস্যার কারনে অনেকে চাষ চাষ করতে নিজেদের পাহাড় ব্যবহার করতে পারেনা। সে লক্ষ্যে দু’পাহাড়ের ঘোনার মধ্যে বাঁধ তৈরী করে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এতে যেমন আমিষের চাহিদা পুরন হবে তেমনি বেকারত্ব দুর হবে, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। মূলত পার্বত্য এলাকায় মাছের চাহিদা বৃদ্ধি করার জন্য সরকার এ্ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

সুত্র জানায়,সরকারের মৎস্য ও প্রানীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যচাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারন প্রকল্প(৩য় পর্যায়) নামে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সে প্রকল্পের অধীনে পার্বত্য তিনটি জেলার ২৫টি উপজেলার প্রত্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ঝিড়ি ও পাহাড়ের মধ্যে ক্রীক তৈরী করে তাতে মাছ চাষের উপযোগী হিসেবে ইতিমধ্যে প্রায় দুশটি ক্রীক তৈরী করা হয়েছে। আরো পাঁচশতাধিক ক্রীক তৈরীর কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যচাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও রাঙ্গামাটি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল হান্নান মিয়া জানান, এ প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পাহাড়ী জনগনের পারিবারিক আয় বৃদ্ধি এবং আমিষের ঘাটতি পূরনে পুষ্টিমান উন্নয়ন করা হবে। তিনি আরো জানান, মৎস্য চাষ উন্নয়নের লক্ষ্যে পাহাড়ে ক্রীক নির্মানের মাধ্যমে যে জলাশয় সৃষ্টি হবে তা পরবর্তীতে পানির রির্জভার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া মাছের পোনা উৎপাদন ও লালন পালনের লক্ষে নার্সারী উন্নয়ন এবং প্রায় ছয় হাজার জনকে মাছ চাষের উপর বিভিন্ন প্রযুক্তি প্যাকেজ ও সম্প্রসারনের লক্ষ্যে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। তিনি আরো জানিয়েছেন এ প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকল্পের মেয়াদকালীন সময়ে সর্বমোট ৮০৪টি ক্রীক নির্মান করা হবে।

কাউখালীর দুর্গম মিতিঙ্গাছড়ি এলাকার সঞ্চয় চাকমা জানান, ২০১০ সালে কাউখালী উপজেলা মৎস্য অফিসে আবেদন করেন ক্রীক নির্মান করে দেওয়ার জন্য। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মৎস্য অফিসের একটি প্রতিনিধিদল মিতিঙ্গাছড়ি এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করে এবং ক্রীক নির্মান হলে কারা কারা সুবিধাভোগী হবে তার সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই করে তা উপজেলা পরিষদ সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করেন। সেখান থেকে যাচাই বাচাই শেষে এ প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা হয়। চলিত বছরের প্রথম দিকে সঞ্চয় চাকমার ক্রীকের দরপত্র আহবান করলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার সেই ক্রীক নির্মান করে মৎস্য অফিসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন। এখন তৈরী করা সেই ক্রীকে অথৈ পানি জমেছে। পুরোপুরি মাছ চাষের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়েছে। সৎ উদ্দেশ্য থাকলে এই ধরনের ভাল করা যায় ।

উল্লেখ্য ২০০৬ সাল হতে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদী তৎকালীন মৎস্য কর্মকর্তা চন্দ্র কুমার চাকমা এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে কোটি কোটি টাকা আত্বসাৎ করার অভিযোগ ঊঠেছে। সেই সময়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তারা অদৃশ্য প্রকল্প দেখিয়ে চন্দ্র কুমার চাকমার কলেজ গেইট এলাকায় চন্দ্র ভবন নামে বিশাল আলিশান বাড়ী গড়ে তুলেছে। পার্বত্য এলাকায় বিপুল জমি ক্রয় করে নিয়েছে। কয়েকটি পত্রিকায় এসব দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও কেউ তদন্ত মনিটরিং করা হয়নি।

কাউখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস,এম চৌধুরী জানান,পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ী ঘোনায় বাঁধ দিয়ে যে ক্রীক তৈরী করা হচ্ছে তা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে এ এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। তিনি ক্রীক গুলো নির্মানের পর সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানান।

কাউখালীতে এ ধরনের আরো যাদের ক্রীক তৈরী করা হয়েছে তাদের মধ্যে মংমং মারমা,পাইচা মং মারমা ও মংচানু মারমা জানিয়েছেন তাদের নিজেদের দু’পাহাড়ের মাঝখানে মাটি দিয়ে বাধ তৈরী করে যে ক্রীক নির্মান করে দেওয়া হযেছে এই ক্রীকে মাছ চাষ করে বেশ কয়েকটি পরিবার অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারবে। এ ধরনের আরো অনেকে তিন পার্বত্য জেলার প্রতিটি উপজেলায় নির্মান করা হয়েছে। এসব ক্রীক তৈরী করতে প্রকল্পের সুবিধাভোগিদের নিকট হতে কোন টাকা পয়সা খরচ হয়নি বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যচাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল হান্নান মিয়া।

এসব ক্রীকে মাছ চাষ সফল হলে পুরো পার্বত্য অঞ্চলের মৎস্য খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে বলে জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন