পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলধারার রাজনীতি করতে মানা পাহাড়িদের

শান্তি চুক্তির ১৯ বছরেও অস্থির পাহাড়-৩

%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%b2%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a3

কাওসার আজম, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ফিরে :

খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নীলবর্ণ চাকমা (৬২)। জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এই সভাপতিকে রাস্তা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় ১০-১২ জন ইউপিডিএফ সদস্য। ‘জীবনে আর কোনো দিন আওয়ামী লীগ করবো না’ এমন মুচলেকা দিয়ে তিনদিন পর অপহরণকারীদের কাছ থেকে নীলবর্ণ চাকমার মুক্তি মিলেছে বলে তার ঘনিষ্ঠজন সূত্রে জানা যায়।

সম্প্রতি পার্বত্য খাগড়াছড়িতে গিয়ে কথা হয় সেখানকার নানা শ্রেণির মানুষ ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তির সাথে। অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে নীলবর্ণের অপহরণের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে আলোচনায়। তবে অনেক চেষ্টা করেও নীলবর্ণকে এ ব্যাপারে মুখ খোলাতে পারা যায়নি। অপহরণের বিষয়টিই তিনি এড়িয়ে যান। বলেন, কিছুই হয়নি। এ সময় তার চোখে ‍মুখে আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে।

নীলবর্ণের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি ইউপিডিএফ অধ্যুষিত বর্মাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন নীলবর্ণ চাকমা। এ নির্বাচনে তিনি তার আপন ভাই ইউপিডিএফ সমর্থিত হরিমোহন চাকমার কাছে হেরে যান।

গত নভেম্বর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খাগড়াছড়ি সফরে যান। খাগড়াছড়িতে ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যাতে না যাওয়া হয়, সেজন্য নীলবর্ণকে আগেই সতর্ক করেছিল পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ নেতাকর্মীরা। তিনি আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি, দলের সাধারণ সম্পাদকের কর্মসূচিতে না গেলে কী হয়? শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দেন। এটাই তার অপরাধ।

জনসভা থেকে ফেরার পথে রাস্তা থেকে তাকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন তাকে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রাখার পর সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেওয়ার মতো সাহস পাননি নীলবর্ণ চাকমা ও তার পরিবার। এমনকি নীলবর্ণ যখন নিখোঁজ, তখন তার স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কেউও অপহরণের বিষয়টি স্বীকার করেননি কারো কাছে।

পার্বত্য খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার (এসপি) মজিদ আলীও জানান নীলবর্ণের অপহরণের বিষয়টি পুলিশকে কেউ অভিযোগ দেয়নি।

ভাগ্য ভালো নীলবর্ণ চাকমার। অপহরণকারীদের কাছ থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু পার্বত্য তিন জেলায় এরকম অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা মূলধারার রাজনীতি করার অপরাধে অপহৃত হয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন। আবার কেউবা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। অনেকেই আছেন যারা অপহরণের পর তাদের পরিবার এখনও জানে না তিনি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন।

যেমনটি হয়েছে বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মংপ্রু মারমার ক্ষেত্রে। গত ১৩ জুন অপহৃত হন তিনি। এরপর থেকে খোঁজ নেই তার। স্বামীর অপেক্ষায় চোখের পানি ফেলেছেন মংপ্রু মারমার স্ত্রী সামা প্রু মারমা।

সামা প্রু মারমা জানান, তার স্বামী মংপ্রু মারমা বান্দরবান সদর থানার ১ নম্বর রাজবিলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বর এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। গত ১৩ জুন রাত ১০টার দিকে তার স্বামী প্রতিবেশি ক্রানু মারমার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা এসে বাইরে থেকে তাকে ডাকাডাকি করে। তিনি ঘর থেকে বের হলে অস্ত্র ঠেকিয়ে দুর্বৃত্তরা তাকে নিয়ে যায়। সেই থেকেই নিখোঁজ তিনি।

এই ঘটনায় ১৪ জুন মং প্রুর জামাতা হামংচিং মারমা বাদি হয়ে বান্দরবান সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা সন্তু লারমার জেএসএসের সদস্য। এর মধ্যে এক নম্বর আসামি কে এস মং মারমা এবং দুই নম্বর আসামি সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন আঞ্চলিক জেলা পরিষদ সদস্য।

মামলায় বলা হয়েছে, আসামিরা জেএসএসের সক্রিয় সদস্য। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মং প্রু আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় দুর্বৃত্তরা নির্বাচনের আগে থেকেই তাকে হুমকি দিয়ে আসছিল। নির্বাচনের পরেও তারা একাধিকবার হুমকি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাকে অস্ত্র ঠেকিয়ে অপহরণ করা হয়েছে।

বান্দরবান সদর থানার ওসি মো. রফিক উল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন, আসামিদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাদের কেউ এখন জেল হাজতে আছে, কেউ আবার জামিনে বেরিয়ে গেছেন। বাকি আসামিদের আমরা গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) শক্তঘাঁটি পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলা। সন্তু লারমা, ঊষাতন তালুকদার এমপিসহ পার্বত্যাঞ্চলের এই আঞ্চলিক সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতাদের বাস এই জেলাতেই।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪শ’ পাহাড়ি উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপর অনেকেই হুমকির কারণে আর আওয়ামী লীগে সক্রিয় থাকতে পারেননি। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক পেয়েও নির্বাচন করতে পারেননি পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ভয়ভীতির কারণে। একই উদাহরণ আছে বিলাইছড়ি উপজেলাসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, বর্তমানে আমরা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায়। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলে ক্ষমতার মালিক জেএসএস আর ইউপিডিএফ। এ দুটি সংগঠন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

তিনি বলেন, বিগত ইউপি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের যারা প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল তাদের প্রচারণা চালাতে দেয়নি। অনেককে তো ঘর থেকেই বের হতে দেয়নি। আমাদের নেতাকর্মীরা ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড কমিটি করতে পারে না। অথচ জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি তো বটেই গ্রাম কমিটিও আছে। তাদের কাছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অসহায়। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের বলা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কোনো ফলাফল আসেনি।

এ ব্যাপারে পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান বলেন, আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভাল।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বলেন, একসময় পার্বত্যাঞ্চলে রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলে এখন আওয়ামী লীগ শক্তিশালী দল। রাজা বা প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে এমন আশঙ্কায় পাহাড়িদের মূলধারার রাজনীতিতে আসতে দিতে চায় না।

তিনি বলেন, জেএসএস বলেন আর ইউপিডিএফ বলেন, তারা সব এক। পার্বত্যাঞ্চলে বিশেষ করে রাঙামাটিতে কোনো পাহাড়ি আওয়ামী লীগ করতে পারবে না বা ব্যবসা করতে পারবে না, এ ধরনের হুমকি আসে। কিন্তু এরপরেও কি একজন পাহাড়ি আওয়ামী লীগ ছেড়েছে? তাদের গ্রুপে ভিড়াতে পেরেছে? পারেনি। কিন্তু বিএনপির উপর যদি এরকম আক্রমণ হয় তাহলে তাদের দলে একজন উপজাতিও থাকবে না।

এ ব্যাপারে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস)কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, অপহরণ বা কারো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ আমাদের নীতির মধ্যে পড়ে না। তবে দীর্ঘ ১৯ বছরেও এ চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় নিচের দিকে (পাহাড়ে বা মাঠ পর্যায়ে) আমাদের অনেক জবাবদিহি করতে হচ্ছে। নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

আমাদের মধ্যেও যেমন শান্তিচুক্তি বিরোধী আছে, তেমনি সরকারের মধ্যেও আছে। এ কারণে বিভিন্ন মহল থেকে এ ধরনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে বা ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন। চুক্তির বাস্তবায়ন হলে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদী তিনি।

এ ব্যাপারে ইউপিডিএফের প্রচার ও প্রকাশনা শাখার প্রধান নিরন চাকমাকে ফোন দেওয়া হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

– দ্য রিপোর্ট

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন