পার্বত্য চট্টগ্রামে মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না আসামি
আবু সালেহ আকন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে
মানুষ অপহৃত হয়। খুন হয়। গুমের ঘটনা ঘটে। থানায় মামলাও হয়; কিন্তু আসামিরা গ্রেফতার হয় না। পাহাড়ে এ অবস্থাই চলে আসছে বছরের পর বছর। পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির কথা স্মরণ করে কাঁদবেন, সেই সুযোগটিও নেই পাহাড়ের কোনো কোনো এলাকায়। তারা ভয়ে থাকেন কখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আবারো হামলে পড়বে, সেই আশঙ্কায়। বছরের পর বছর এভাবে পড়ে থেকে কোনো কোনো মামলা তামাদি হয়ে যায় থানাতেই। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এক সময় মামলার কথা ভুলে যায়।
বান্দরবানের আলিকদম উপজেলার ২নং চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের উবায়দুল হাকিম পাড়ার আবুল হাসেম। তার ছোট ভাই আবু বকর (২৬) খুন হয়েছেন গত এপ্রিলে। আবুল হাসেম বলেন, গত ১৫ এপ্রিল জোহন ত্রিপুরা নামে এক পাহাড়ি আবুবকরের কাছে ৯টি গরু বিক্রির কথা বলে। জোহন আবু বকরকে জানায় ৯টি গরু বাবদ ৩ লাখ টাকা দিতে হবে। আবু বকর তার সঙ্গী নুরুল আফসার ও শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে মোটর সাইকেলে বান্দরবানের থানছি উপজেলার ২৮ মাইল এলাকায় যায়।
অস্থির পাহাড় দিশেহারা মানুষ-৭
হাসেম বলেন, বেলা ১১টায় আবু বকর তার অপর ছোট ভাই আবু নাঈমের কাছে ফোন করে বলে আরো ৫০ হাজার টাকা লাগবে। দুইটি পার্সোনাল নম্বরে আবু নাঈম ওই টাকা বিকাশ করে দেয়। ওই টাকা রিসিভ করার কয়েক মিনিট পরেই দেখা যায় আবুবকরের মোবাইল ফোন বন্ধ। বাকি দুইজনেরও মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ওই দিন ছিল শুক্রবার।
হাসেম বলেন, জুমার নামাজের পর তার ভাইসহ বাকিদের খুঁজতে বের হন। থানছি বাজারে তাদের যারা পরিচিত ছিল সবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কেউ বলতে পারেনি ওই তিনজনের কথা। পর দিন ১৬ এপ্রিল তারা ওই এলাকায় গিয়ে জোহন ত্রিপুরার সাথে যোগাযোগ করেন। নিখোঁজ তিনজনের কথা জানতে চাইলে জোহন ক্ষেপে যায়।
হাসেম থানছি থানায় গিয়ে ঘটনার ব্যাপারে জোহন ও জসিম নামে দুইজনকে অভিযুক্ত করে একটি জিডি করেন। ওই সূত্র ধরে পুলিশ জোহন ও জসিমকে আটক করে। একপর্যায়ে জোহন স্বীকার করে আবু বকর, নুরুল ও শাহাবুদ্দিনকে তারা অপর এক গ্রুপের হাতে তুলে দিয়েছে। তারা কী করেছে তা বলতে পারবে না। পর দিন বিকেল ৪টায় তাদের লাশ পাওয়া যায়।
জোহন জানায়, প্রথমে টাকা পয়সা নিয়ে তাদের গরু দেয়ার কথা বলে একটি নির্জন স্থানে বেধে রাখা হয়। পরে তাদের পাথর ও লাঠি দিয়ে মাথা, হাত-পা থেতলে হত্যা করা হয়। ঘটনার ব্যাপারে জোহন, জন ব্যাক, জসিন, জর্জ, জীবন, আকাশ, সানি, জসেফ, সালো ও জনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর মধ্যে জোহন ও জসিম ছাড়া অন্য কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
আবুল হাসেম জানান, আবু বকর নিহত হওয়ার খবর শুনে তার ভাই হাজী ওমর হামজা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৫ জুন তিনি মারা যান। আবুল হাসেম বলেন, ভাইকে হারিয়ে তারা দিশেহারা। মামলার পর সন্ত্রাসীরা উল্টো তাদের হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নিতে। পুলিশ এ তিন খুনের আসামিদের গ্রেফতার না করলেও ঘটনার পর অজ্ঞাত লোকজন এক পাহাড়ির ঘর জালিয়ে দিলে ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৬ বাঙালিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পরিস্থিতি ঘোলাটে করতেই খুনিদের পক্ষ থেকে ওই ঘরটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার প্রায় দুই হাজার মানুষ এখনো ঘরছাড়া।
নুরুল আফসারের শ্বশুর নুরুল কবির বলেন, তার জামাই গরু ব্যবসা করত। আফসারের দুই মেয়ে। দুর্বৃত্তদের হাতে সে খুন হওয়ার পরে পুরো পরিবার এখন দিশেহারা। এ বৃদ্ধ বয়সে এখন মেয়ে ও দুই নাতনীর ভরণপোষণ জোগাতে দিনরাত তাকে পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী সাবিকুন্নাহার বলেন, তাদের দুই ছেলে মেয়ে। স্বামী নিহত হওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে সাবিকুন্নাহার তার বাবার বাড়িতে উঠেছেন। তার বাবা একজন দিনমজুর। স্বামীকে হারিয়ে এখন তিনি পাগলপ্রায়। এমনো মামলা রয়েছে বছরের পর বছর ওভাবেই পড়ে আছে।
খাগড়াছড়ির ভুয়া ছড়ি এলাকার বাসিন্দা শহর আলী অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার ছেলেকে খুন করা হয়। ওই সময় তার ছেলে কাস সেভেনে পড়ত। বিজিক্কা চাকমা, মিন্টু চাকমা ও সুমন চাকমাসহ ইউপিডিএফের কিছু সন্ত্রাসী তার ছেলেকে হত্যা করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছিলেন। মামলার পর পুলিশ উল্টো তাকে হয়রানি করে। পুলিশ আসামিদের বাড়িতে যেত না। এমনকি তাদের গ্রেফতারে কোনো তৎপরতা ছিল না। কিন্তু প্রতিদিন তল্লাশির নামে পুলিশ তার বাড়িতে যেত। মামলাটি কী অবস্থায় আছে এখন তারও খোঁজ নেন না শহর আলী।
পানছড়ির আব্দুল গনি বলেন, তার মেয়ে রোকসানাকে (২০) চার বছর আগে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে। দুর্বৃত্তরা তার মেয়ের শরীরে ৩০টি ছুরিকাঘাত করে হত্যার পর একটি পাহাড়ি ছড়ার মধ্যে লাশ ফেলে রাখে। ওই ঘটনায় মামলা করা হলেও তিনি কোনো বিচার পাননি। মামলার পর পুলিশ ঘটনার তদন্ত না করে উল্টো তাকে নিয়মিত ধমকাতো। এরপর তিনি আর মামলার কোনো খোঁজ নেননি। পানছড়ির ইসলামপুরের খোকন বলেন, তার স্ত্রীকে দুর্বৃত্তরা পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে খুন করেছে সাত বছর আগে। কিন্তু বিচার পাবেন না এই আশঙ্কায় তিনি কোনো মামলা করেননি।