পার্বত্য চট্টগ্রামে বেতনের ১৫ শতাংশই চাঁদা : না দিলে অপহরণ নির্যাতন হত্যা

পাহাড়ে অশান্তির আগুন ২

চাঁদাবাজি

ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে :
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুরগি ডিম দিলে, ক্ষেতে ফসল হলে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি যাই হোক না কেন তার জন্য নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় পাহাড়ের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে।

জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-সন্তু লারমা গ্রুপ) ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নির্ধারিত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই শুরু হয় অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ। পুড়িয়ে দেয়া হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর, যানবাহন। নাকের ডগায় বসে অনেকটা ফ্রি-স্টাইলে এই চাঁদাবাজি চললেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন। যারা ব্যবস্থা নিবেন সেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেও বেতনের ১৫ শতাংশ চাঁদা দিতে হয় তিনটি গ্রুপকে (জেএসএস-সন্তু, জেএসএস-সংস্কার ও ইউপিডিএফ)।

সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। চাঁদা পরিশোধের পর সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে রশিদ। চাঁদার ক্ষেত্রেও আবার রয়েছে হেরফের। উপজাতিদের চেয়ে বাঙালিদের চাঁদার রেট কিছুটা বেশি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে। আর বছর শেষে প্রতিটি গ্রুপই (জেএসএস-সন্তু, জেএসএস-সংস্কার ও ইউপিডিএফ) সমগ্র পার্বত্য অঞ্চল থেকে আদায় করছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার চাঁদা।

চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। এই দিয়েই দলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রেশন, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি দেয়া হয়। এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার এ অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে বাঙালি বিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার কাজ করে থাকে বলেও জানা গেছে। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় নির্যাতন, নিপীড়ন, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ। প্রাণভয়ে মুখও খুলতে চান না তারা। স্বয়ং পুলিশ প্রশাসনও তাদের কাছে পণবন্দি বলে অভিযোগ।

চাঁদাবাজি

পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজি সেখানে একটি স্বীকৃত বিষয়। সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স না দিলেও বাধ্যতামূলকভাবে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। থানা ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো প্রতিকার পান না ভুক্তভোগীরা। দুর্গম এলাকা, লোকবল সঙ্কটসহ নানা কারণে অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছে প্রশাসনও।

ভুক্তভোগী বাঙালি ও উপজাতিরা অভিযোগ করেন, হাঁস/মুরগি, গরু/ছাগল, গাছের ফল, ক্ষেতের ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মৎসজীবী, সড়কে চলাচলকারী সকল প্রকার যানবাহন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্থানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশীয় ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, জমি কেনাবেচা, কাঠ-বাঁশ হেন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখান থেকে তারা চাঁদা আদায় করে না।

অন্যমিডিয়া

তাদের অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকার চাঁদা তোলে উপজাতিদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। দিনে দিনে এই চাঁদাবাজি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও।

সরকারের কাছে দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফ এর সন্ত্রাসী কর্তৃক চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ৮০ শতাংশ শর্ত বাস্তবায়ন করলেও জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দোহায় দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় ও আধিপত্য বিস্তার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা/ফোরামের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রচার-প্রপাগা-া চালাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে গোপনে যোগাযোগের মাধ্যমে চাঁদাবাজি ও অপহরণের পর মুক্তিপণের অর্থ দিয়ে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে তাদের অস্ত্রভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতীদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমিসহ কথিত স্বায়ত্ত্বশাসন আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকা- পরিচালনা, অস্ত্র সংগ্রহ, আন্তর্জাতিক ফোরামের সাথে যোগাযোগ/লবিং প্রচার-প্রচারণা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য ও আন্দোলনে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করাসহ এসব কারণে তারা নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। স্থানীয়রা ছাড়াও পর্যটক, টোকেন ছাড়া ব্যবসায়ী, ব্যবসা ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের অপহরণ করে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে।

গত ২৯ নভেম্বর খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নিলবর্ণ চাকমাকে অপহরণ করা হয়। এখনো তিনি নিখোঁজ। অক্টোবরে খাগড়াছড়ির রামগড়ে সশস্ত্র উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণের ১২ ঘন্টা পর আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পান তিন ব্যবসায়ী।

একই সময়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী এলাকায় পিএইসপি রাবার বাগান থেকে ৩ প্রহরীকে অপহরণ করে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। সেপ্টেম্বরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের বাকঁখালী মৌজা থেকে দুই তামাক চাষীকে অপহরণের পর গহিন অরণ্যে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়।

সারা বছরই এভাবে কোনো না কোনো স্থানে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। গত বছর সেপ্টেম্বরে রাঙামাটির বানিয়ারচর এলাকায় কাপ্তাই লেকে মাছ ধরার সময় জেএসএস-সংস্কার গ্রুপের সন্ত্রাসীরা ৩ জন বাঙালি জেলেকে অপহরণ করে পরে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।

অক্টোবরে বান্দরবান থেকে দুইজন পর্যটক অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। তবে যৌথবাহিনীর অভিযানে তারা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হন। বিগত দিনে যত অপহরণের ঘটনা ঘটেছে তার কোনোটিই তারা মুক্তিপণ ছাড়া ছেড়ে দেয়নি।

সূত্র মতে, চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। সরকারের করের ন্যায় বিভিন্ন জিনিসের ওপর মাসিক/বার্ষিক নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করা হয় এবং রসিদও দেওয়া হয়। ক্যাডার পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব সশস্ত্র সদস্যের বেতন-ভাতাও দেওয়া হয় বলে বলে জানা গেছে।

সরেজমিন গিয়ে এবং স্থানীয় ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পার্বত্য এলাকায় চলাচলকারী প্রতিটি বাসের (৩০০ বাস আছে) জন্য বছরে জেএসএস (সন্তু) ও জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপকে ৫ হাজার করে ও ইউপিডিএফকে ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।

ট্রাকের জন্য (৩০০টি) জেএসএস ও সংস্কারকে ৬ হাজার করে ও ইউপিডিএফকে ৪ হাজার, চাঁদের গাড়িতে জেএসএস ৩ হাজার, সংস্কার ২ হাজার ও ইউপিডিএফ দেড় হাজার, মাইক্রো/কারের জন্য জেএসএস ৪ হাজার, সংস্কার আড়াই হাজার, ইউপিডিএফকে ২ হাজার, সিএনজিতে তিন গ্রুপকে দেড় হাজার করে, টমটম/অটোরিক্সায় ৬শ’ করে, ট্রাক্টরে এক হাজার করে, মোটরসাইকেলের জন্য ৫শ’ টাকা করে চাঁদা পরিশোধ করে।

বাইরে থেকে কোনো ওষুধ কোম্পানির গাড়ি ঢুকলে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপকে ১০ থেকে ৪০ হাজার, জেএসএস সংস্কার গ্রুপকে ১০ থেকে ২৫ হাজার, ইউপিডিএফকে আট থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিলারশিপ নিলে তিনটি গ্রুপকে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর জন্য সন্তু ও সংস্কার গ্রুপকে ৮ লাখ করে এবং ইউপিডিএফকে ৬ লাখ টাকা, আবুল খায়ের টোবাকোর সন্তু গ্রুপকে চার লাখ, সংস্কারকে ৩ লাখ ও ইউপিডিএফকে দুই লাখ, আকিজ গ্রুপের সন্তু গ্রুপকে ৩ লাখ অন্য দুই গ্রুপকে দুই লাখ করে।

তামাক ক্ষেতের জন্য একর প্রতি এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা, তামাক চুলার প্রতিটির জন্য এক হাজার করে, ব্রিক ফিল্ডের বাৎসরিক চাঁদা তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। ঠিকাদারি বা উন্নয়ন কাজের জন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে বাজেটে বরাদ্দ পাওয়া মোট অর্থের ৮ থেকে ১০ শতাংশ দিতে হয় জেএসএস সন্তু লারমার গ্রুপকে, ৬ থেকে ৭ শতাংশ জেএসএস সংস্কারকে এবং ৪ থেকে ৫ শতাংশ দিতে হয় ইউপিডিএফকে।

তিন জেলায় উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপদ, এলজিইডি, পিডব্লিউডি, পাবলিক হেলথ, স্থানীয় সরকারের অধীনে বছরে প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার কাজ হয়ে থাকে। যার মধ্যে ১১ থেকে ১২ শতাংশ অর্থ বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয় জেএসএস সন্তু, সংস্কার ও ইউপিডিএফকে। জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে মোট দামের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দিতে হয় সন্তু গ্রুপকে, ৮ থেকে ১০ শতাংশ সংস্কার ও ৬ থেকে ৭ শতাংশ ইউপিডিএফকে। শ্যালু মেশিন/মেশিনারিজ কিনলে প্রতি হর্সে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা প্রতিটি গ্রুপকে দিতে হয়।

জুম চাষের জমি বিক্রি করলে সন্তু গ্রুপকে মোট দামের ১০ শতাংশ এবং অন্য দুই গ্রুপকে বিঘা প্রতি ২৫০ টাকা, এক ফসলি জমিতে চাষ করলে উৎপাদিত ফসলের বিক্রির ১০ শতাংশ জেএসএস সন্তুকে অন্য দুই গ্রুপকে বিঘা প্রতি ৩০০ টাকা, দুই ফসলি জমিতেও ফসলের জন্য এক গ্রুপকে ১০ শতাংশ ও অন্য দুই গ্রুপকে বিঘা প্রতি ৫০০ টাকা করে দিতে হয়।

মৌসুমী ভিত্তিক ফসল (ধান, চাল, ভুট্টা, আলু, বেগুনসহ সবধরণের পণ্য) বিক্রি করলে সন্তু গ্রুপকে বিক্রি মূল্যের ১০ শতাংশ ও অন্য দুই গ্রুপকে মণ প্রতি ৪০ থেকে ৬০ টাকা হারে দিতে হয়। আম, লিচু, আনারস, কমলা, কলার ছড়া, কাঠাল, গরু, ছাগল/শুকর, হাস/মুরগি ইত্যাদি বিক্রির ক্ষেত্রে জেএসএস সন্তু গ্রুপকে বিক্রি মূল্যের ১০ শতাংশ দিতে হয়। অন্য দুই গ্রুপকে পণ্য ভেদে ৫ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।

যে কোন ব্যবসার ডিলারশীপ নিলে ইউপিডিএফকে বছরে ৩ লাখ, জেএসএস ও সংস্কার গ্রুপকে ৫ লাখ টাকা করে দিতে হয়। সেগুন, গামারি ও অন্যান্য কাঠের জন্য প্রতি ঘনফুরে ৫০ থেকে ৭০ টাকা করে, কাঠ বোঝাই প্রতিটি ট্রাকের জন্য ১২ থেকে ১৬ হাজার করে, কাচা পণ্য/কলা/কাঠাল বোঝায় প্রতিটি ট্রাকের জন্য ৩ থেকে ৪ হাজার, বালুর ট্রাকে ৫শ’ থেকে ৭শ’, মুলি বাশেঁর ট্রাকে ২শ’ থেকে ৩শ’, বাইজ্জা বাঁশে ১২শ’ থেকে ১৮শ’, মাছ ব্যবসায়ীদের বাৎসরিক ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা, রাইস মিলের প্রতিটি মেশিনের জন্য ৫ থেকে ৬ হাজার, স’মিলের জন্য সন্তু গ্রুপকে ৫০ হাজার, সংস্কার ও ইউপিডিএফকে ৫ হাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।

প্রথম শ্রেণির সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদেরকে ১২ মাসের বেতনের ৫ শতাংশ করে মোট ১৫ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিজীবীদের ৩ শতাংশ, উচ্চবিত্ত পরিবারকে মাসে ৬শ’ টাকা হারে, মধ্য বিত্তকে মাসে ৫শ’ এবং নি¤œবিত্তকে মাসে ৩শ’ টাকা হারে প্রতিটি গ্রুপকে পৃথকভাবে দিতে হয়।

টেলিকেন্দ্রের জন্য এক থেকে দেড় লাখ, বাজার ডাকার ক্ষেত্রে প্রতিটি বাজারে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার (তিন জেলায় ৩০টি বাজার), কুরিয়ার সার্ভিসের যানবাহনের জন্য এক থেকে দেড় লাখ, গ্রুপ অব কোম্পানির যানবাহনের ৫০ হাজার থেকে এক লাখ, নির্বাচনে প্রার্থী হলে এক হাজার টাকা করে তিনটি গ্রুপকে মোট তিন হাজার টাকা দিতে হয়।

এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, জুম্ম জাতীয় নেতার মৃত্যু দিবস, দলের কাউন্সিল, বৈসাবি/বিজু/সাংগ্রাই, পূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা/বিহার/মন্দির, কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান ইত্যাদির নামে ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠান, মালিক সমিতি, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, ব্যাংক, এনজিও, সরকারি-বেসরকারি অফিস ইত্যাদির কাছ থেকে প্রথমে চিঠি এবং রশিদ দিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্বত্য অঞ্চলে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস দমন কমিটির একজন নেতা বলেন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, সন্ত্রাসের প্রতিবাদে আমরা শাপলা চত্বরে মানববন্ধন করি। এরপরে আমার ও মেয়রের নামে কাফনের কাপড় ও বুলেট পাঠিয়ে দেয়া হয়।

বাস মালিক সমিতি ও কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা অভিযোগ করে বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি অহরহ ঘটছে। চাঁদাবাজিতে তারা কারো চেয়ে কেউ পিছিয়ে নেই। কোনো পরিবহন মাল নিয়ে খাগড়াছড়ি ঢোকার সময় অথবা বের হওয়ার সময় চাঁদা দিতে হয়। একেক সময় তারা একেক স্থান থেকে চাঁদা তুলে।

চাঁদা না দিলে গাড়ি থামিয়ে স্টাফদের মারধর করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। চাঁদা না দেয়ায় গত সপ্তাহেই বিআরটিসি’র একটি ও প্রাণ আরএফএল গ্রুপের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ইউপিডিএফ। পুলিশের কাছে অভিযোগ কেন করেন না জানতে চাইলে তারা বলেন, পুলিশের কাছে অভিযোগ করে কোন লাভ হয় না। আর পুলিশ যে অভিযোগ পাওয়ার পর কোন ব্যবস্থা নেবে সে আস্থাও তাদের উপর আমাদের নেই।

মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বলেন, চাঁদা ছাড়া কোনো জমিতে চাষ করা যায় না, গাড়ির চাকা ঘোরে না, চাকরিজীবীরা চাকরি করতে পারে না, ব্যবসা করা যায় না চাঁদা না দিলে। এমনকি নদীতে মাছ ধরতে হলেও চাঁদা দিতে হয়। তাদের কাছ থেকে চাঁদা দিয়ে টোকেন নিতে হয়। সেই টোকেন দেখালেই কাজ করার অনুমতি মেলে। তা না হলে তুলে নিয়ে যায়, নির্যাতন করে অনেক ক্ষেত্রে মেরে ফেলে।

পুলিশ প্রশাসন তাদের লোকবলের সংকটের কারণে অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছেন। খাগড়াছড়ি জেলার এসপি আব্দুল মজিদ বলেন, পাবর্ত্য এলাকা দুর্গম এবং সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় থাকে। মাঝে মাঝে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় এবং ধরা পরে।

রাঙামাটি জেলার এসপি সাঈদ তরিকুল হাসান বলেন, অনেকেই অভিযোগ করতে ভয় পায়। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে এবং গ্রেফতার করে। তবে পার্বত্য এলাকার ভৌগলিক, সড়ক, ভাষার প্রতিবন্ধকতা, সচেতনতার অভাব ও লোকবল সঙ্কটের কথা তিনিও জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেএসএসের মুখপাত্র ও সহ-প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, ‘জেএসএসের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা চাঁদাবাজি করি না। পাহাড়িদের কল্যাণে কাজ করি। তাদের আদায় করা চাঁদার রশিদ হাতে রয়েছে বললে তিনি বলেন, সেটা জেএসএসের নামে অন্য কেউ করতে পারে। আমাদের নয়।

ইউপিডিএফ’র মুখপাত্র, প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমাও এসব চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন। চাঁদা দাবির চিঠি আছে জানালে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। মানুষের সহযোগিতায় তাদের দল পরিচালিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, চাঁদাবাজি এখানে ওপেন সিক্রেট বিষয়। তবে ভয়ে কেউ মামলা করছে না। সশস্ত্র গ্রুপ চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা সকল পর্যায়ে চাঁদা আদায় করে থাকে। তাদের চাঁদাবাজির কারণে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ। তিনি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সবার আগে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। এগিয়ে এসে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। র‌্যাবের ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন আছে বলেও তিনি মনে করেন।

সূত্র- দৈনিক ইনকিলাব

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন