পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও ভূমি প্রসঙ্গ

জেনারেল ইব্রাহীম

মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহীম

পত্রিকায় কলাম লেখা বেশি পরিশ্রমের কাজ; টেলিভিশনের টকশোতে বক্তব্য রাখা কম পরিশ্রমের কাজ; কিন্তু উভয়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এই কাজের জন্য অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়। কারণ সবার কাছে সব কথা প্রিয় হয় না। যাদের কাছে অপ্রিয়, তারা যেন শত্রু হয়ে যান। তাদের কেউ কেউ মনস্তাত্ত্বিকভাবে, সামাজিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, দৈহিকভাবে যেকোনো রকমেই হোক না কেন, ক্ষতি করতে বদ্ধপরিকর। সে জন্য অনেক সময় মনে প্রশ্ন জাগে, এত বলাবলি এবং এত লেখালেখির ফল কী? অতি প্রাচীন বাংলা প্রবাদ আছে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’। অর্থাৎ, আমার পরিশ্রমের ফলটা যদি দেখতে না পারি বা অনুধাবন করা না যায়, তাহলে ফল উৎপাদনকারী বৃক্ষের পরিচয় কিভাবে বিকশিত হবে? কঠিন প্রশ্ন বৈকি!

পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের সূত্রপাত
গত ১৮ তারিখের কলামে শেষ করেছিলাম এই বলে যে, মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম যখন জিওসি’র দায়িত্বে ছিলেন, তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক, মধ্যমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ অনেক এবং দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ অনেক এবং নৈমিত্তিক অথবা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। জেনারেল মঞ্জুর দায়িত্ব নেয়ার আগে, ১৯৭৬ সালের শুরুর দিকেই, তদানীন্তন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আগ্রহে ও নির্দেশনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন করা হয়। ওই অঞ্চলের জন্য আলাদা বরাদ্দ দেয়া শুরু হয়। এই উন্নয়ন বোর্ডের কাজ ছিল স্থানীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং স্বাধীনভাবে অথবা অন্যান্য সরকারি বিভাগ বা দফতরের সাথে মিলিতভাবে এমন সব প্রকল্প হাতে নেয়া, যার মাধ্যমে পাহাড়ি বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠী একাধিক উপার্জনকারী পেশার সাথে পরিচিত হতে পারে এবং এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। উন্নয়ন বোর্ডের সদর দফতর ছিল রাঙ্গামাটি শহরে। দূরদর্শী লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম চাইলেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য পেশাগত বৈচিত্র্য আনতে। কারণ, সময়ের পরিক্রমায় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যখন বাড়বে, তখন অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে একাধিক পেশা প্রয়োজন হবে। জিয়াউর রহমান পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী ছিলেন।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সম্পূরক প্রয়োজনীয়তা
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করতে গেলে কন্ট্রাক্টর, যন্ত্রপাতি, প্রচুর শ্রমিক ইত্যাদি লাগে। যে এলাকায় এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, সে এলাকার জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। এখন ২০১৫ সালের মার্চ মাসে যারাই এই কলাম পড়ছেন, তাদের মধ্যে যারা তরুণ, তারা কি কল্পনা করতে পারবেন ৩০ বা ৩৫ বা ৪০ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন ছিল? ১৯৭৬-৭৭-৭৮ সালের কথা। যখন সড়ক নির্মাণের প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হলো, তখন শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ল। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জুম চাষ, বাঁশ কাটা বা শন কাটা (ইংরেজিতে শনকে সানগ্রাস বলা হয়) ব্যতীত কায়িক শ্রমের অভ্যাস ছিল না। কন্ট্রাক্টর, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে গিয়েছেন। সে অবস্থায় শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে? শ্রমিকও বাইরে থেকে নিতে হলো। রাতে শ্রমিকেরা ঘুমায় লম্বা বেড়ার ঘরে। শান্তিবাহিনী কঠোরভাবে ধমক দেয় পাহাড়িদের, যেন তারা কোনো অবস্থাতেই এসব কাজে শ্রম না দেয়। পাহাড়িদের কঠোরভাবে ধমক দিলো, তারা যেন বাঙালি কন্ট্রাক্টর, বাঙালি শ্রমিক প্রভৃতি সম্প্রদায়কে কোনো প্রকার সহযোগিতা না করে। নির্মাণাধীন রাস্তা বা সড়কের পাশে যেসব পাহাড়ি গ্রাম পড়ত, সেসব গ্রামে অবস্থান নিয়ে শান্তিবাহিনী, সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর আক্রমণ চালাত, তথা অ্যাম্বুশ করত। অথবা শ্রমিকদের আক্রমণ করত। শান্তিবাহিনী কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে অনেক বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করত এবং অবশ্যই সেই চাঁদা পেত। এতদসত্ত্বেও, শান্তিবাহিনী কন্ট্রাক্টরের যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দিত। সে অবস্থায় তিনটি প্রয়োজন দেখা দিলো। প্রথম প্রয়োজন হলো, অনেক শ্রমিক; দ্বিতীয় প্রয়োজন হলো শ্রমিক ও কন্ট্রাক্টরদের পাহারা বা নিরাপত্তা দেয়া; তৃতীয় প্রয়োজন হলো- নিরীহ সাধারণ পাহাড়ি জনগণকে বোঝানো যে, এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাদের জন্যই।

শান্তিবাহিনী কী বোঝাত?
শান্তিবাহিনী পাহাড়ি মানুষকে বোঝাত এই বলে যে, রাস্তাঘাট যদি হয়, তাহলে সেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারি চলাচল করবে, বাঙালি ব্যবসায়ীরা চলাচল করবে, সেই রাস্তাঘাট দিয়ে বাইরের লোকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীরে প্রবেশ করবে। বাইরের লোকেরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীরে প্রবেশ করে, তাহলে তোমরা সাধারণ মানুষেরা টিকে থাকতে পারবে না, তোমাদের বিধর্মী এবং বাঙালি বানিয়ে ফেলবে। সুতরাং এসব জিনিস বানাতে দেয়া যাবে না। উন্নয়নমূলক প্রকল্পের অন্য একটি উদাহরণ হলো, রাবার বাগান প্রকল্প। শান্তিবাহিনী মানুষকে বোঝাত, রাবার বাগানের রাবার তোমাদের কোনো কাজেই আসবে না, এই রাবার বাঙালিরাই কিনবে। শান্তিবাহিনী বোঝাত এই বলে যে, তোমরা যদি পিতৃপুরুষের জুমচাষ বন্ধ করে রাবার বাগান বা এ ধরনের প্রকল্পে যুক্ত হও, তাহলে এসব বাগানের আশপাশেই বসতি করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ তোমাদের বন্দী করে ফেলছে বাঙালি সরকার, রাবার বাগানের নাম দিয়ে। অতএব তোমরা রাবার বাগানে কাজ করবে না।

সম্মানিত পাঠক, রাবার বাগানে প্রত্যেক পাহাড়ি পরিবারকে চার, পাঁচ অথবা ছয় একর করে জমি দেয়া হতো। সুন্দরভাবে ঘর নির্মাণ করে বাস করার জন্য, অর্থাৎ বসতভিটার জন্য ও বসতভিটার চতুর্পাশে পারিবারিক প্রয়োজনের সবজি ও ফল ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য কমবেশি এক একর জমি দেয়া হতো। অনেক পরিবারের জমি যখন পাশাপাশি পাওয়া যায়, তখন পুরো রাবার বাগানটি পঞ্চাশ বা ষাট বা সত্তর বা দেড় শ’ দুই শ’ একরের হয়ে যায়। অনেক পাহাড়ি পরিবার যখন এক জায়গায় পরিকল্পিতভাবে বসবাস শুরু করে, তখন তাদের কিছু না কিছু স্বাস্থ্যসুবিধা, লেখাপড়ার সুবিধা, উপাসনার সুবিধা ইত্যাদি দেয়া সম্ভব ও সহজ হয়। ইত্যাদি সুবিধা দিলে মানুষ রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি আগ্রহী হয়। সরকার এটাই চাইত। কিন্তু শান্তিবাহিনী কোনো মতেই চাইত না, পাহাড়ি জনগণ বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি আগ্রহী হোক। যা হোক, শান্তিবাহিনীর না-চাওয়া এবং সরকারের চাওয়া, এই পরস্পর বিরোধিতার মাঝেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয় এবং স্থিতি পায়। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক ছিল। বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দমনের জন্য এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা দেয়ার জন্য, সেনাবাহিনী যেমন প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তেমনি সরকারের প্রতি অনুগত ও সেনাবাহিনীর প্রতি সহযোগিতার মনোভাব সম্পন্ন, ভিন্ন জনগোষ্ঠীরও প্রয়োজন পড়ে।

সন্তু লারমা : গ্রেফতার মুক্তি ও সংলাপ
এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার কিছু দিন পর, জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর জ্যেষ্ঠতম নেতা ও অধিনায়ক মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আপন ছোট ভাই এবং দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ নেতা ও অধিনায়ক জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সংক্ষেপে জেবি লারমা, তবে অতি সুপরিচিত নাম ‘সন্তু লারমা’) খাগড়াছড়ির একটি জায়গায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন বেশ কিছু কাগজপত্রসহ। সন্তু লারমা গ্রেফতার থাকা অবস্থায় তার কাছে একাধিকবার প্রস্তাব দেয়া হয় যে, আপনি ফিরে যান এবং সরকার ও আপনাদের নেতাদের মধ্যে আলোচনার বন্দোবস্ত করুন। একপর্যায়ে তাকে একতরফাভাবেই সরকার বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়। মুক্তি দেয়ার সময় সরকার বলে দেয়, (অনেকটা এরকম) আপনি ফিরে গিয়ে আপনাদের নেতাদের বোঝান, যেন তারা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেন। সরকার আলোচনায় প্রস্তুত। আপনাদের বিদ্রোহের কারণগুলো আমরা সৃষ্টি করিনি। আপনারা বিদ্রোহ করেছেন বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর। কিন্তু আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু যদি আপনারা আলোচনায় না আসেন, তাহলে সরকার একতরফাভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। কারণ, এভাবে বিদ্রোহ চলতে দেয়া যাবে না। বিদ্রোহ দীর্ঘমেয়াদি হলে দেশের নিরাপত্তার জন্য তা মারাত্মক হুমকি। সম্মানিত পাঠক, জেনে রাখুন, সন্তু লারমা মুক্ত হয়ে ফেরত গিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তার আপন বড় ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ বাহিনী ও সরকার পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরু করাতে পারেননি। অতএব, সরকার অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল (১৯৭৯ সাল)।

বাঙালিদের বসতি স্থাপনের ভালোমন্দ
ওপরের তিনটি অনুচ্ছেদে আলোচনার প্রেক্ষাপটে, আমার মূল্যায়ন হলো, জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে, বৈরী পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশে একটি বন্ধুপ্রতিম জনগোষ্ঠী সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল বলেই কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দুস্থ, ভূমিহীন বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হবে। এই সুবাদেই ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালের প্রথম কয়েক মাসে কয়েক হাজার বাঙালি পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অংশে বসতি স্থাপন করেছিল। সরকার কর্তৃক এ কাজে সহায়তা করা হয়েছিল, কিন্তু ওই পদ্ধতিতে বা প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি ছিল, যেগুলো কিছু দিনের মধ্যেই মারাত্মক নেতিবাচক ফল দেয়া শুরু করে। ওই তিন-চার বছরে যেসব বাঙালি পরিবার বসতি স্থাপন করেছিল, তাদের শান্তিবাহিনীর লোকেরা এবং স্থানীয় জনগণ, ‘সেটেলার বাঙালি’ বলত। এরূপ বসতি স্থাপনের বহু আগে থেকেই যেসব বাঙালি পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে আসছিল, তাদের বলা হতো আদি বাঙালি। সেটেলার বাঙালিরা, অতি দ্রুতই শান্তিবাহিনীর মারাত্মক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এই বাঙালিরা আক্রান্ত হলে প্রতিশোধের নিমিত্তে নিকটবর্তী পাহাড়ি গ্রামে আক্রমণ করত। সেটেলার বাঙালিরা পাহাড়ি গ্রামে আক্রমণ করলে পাহাড়িরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হতো; কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হলো- পাহাড়িরা গ্রাম ছেড়ে নিকটবর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নিত এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিত। এই প্রক্রিয়ায় ভারতে চাকমা শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। শরণার্থী হলে শান্তিবাহিনীর আরেক ধরনের বড় লাভ ছিল। শান্তিবাহিনী তখন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে তরুণ যুবকদের উদ্দীপ্ত করত যেন তারা শান্তিবাহিনীতে তথা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগ দেয়। অপর দিকে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশী চাকমা শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশ সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি নেতিবাচক ইস্যু ছিল।

ভূমি সমস্যার প্রাথমিক চিত্র
শুধু আলোচনার খাতিরে একটি বছর ধরি, যেমন ১৯৭৯ সাল। তখন থেকে ১৯৮৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অনেকবার পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ হয়েছে। উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ভারতের মাটিতে শরণার্থী সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঙালিদের বসতি করতে দেয়ার সময় তাদের চাষাবাদ করে বেঁচে থাকার জন্য পরিবারপ্রতি কৃষিজমি দেয়া হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে কৃষি জমিগুলো তাদের গ্রামের কাছে ছিল। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জমিগুলো গ্রাম থেকে দূরে ছিল। সর্বক্ষেত্রেই কৃষিকাজ করতে গেলে বাঙালি কৃষকেরা শান্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হতো। শান্তিবাহিনী বা পাহাড়িরা বলত, পাহাড়িদের জমি বাঙালিদের দেয়া হয়েছে। সরকার বলত, সরকারের জমি তথা খাসজমি, যেগুলো কোনোমতেই পাহাড়িদের নয়, সেগুলো বাঙালিদের দেয়া হয়েছে। পাহাড়িরা বলত, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জমির সমষ্টিগত মালিক পাহাড়িরা, অন্য কেউ মালিক হতে পারবে না। তিনটি বাস্তবতা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথম বাস্তবতা, পাহাড়ে কোনো দিন ওই ধরনের ভূমি জরিপ হয়নি, যে ধরনের ভূমি জরিপের সাথে ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল থেকে বাঙালিরা পরিচিত। দ্বিতীয় বাস্তবতা, পাহাড়ে যেহেতু পাহাড়ের সংখ্যা বেশি এবং পাহাড়ি মানুষের সংখ্যা কম ছিল, সেহেতু জমির ব্যবহার সমষ্টিগতভাবেই বেশি হতো। সমষ্টিগত ব্যবহারের নির্দেশনা প্রথাগত নেতারাই দিতেন; যথা পাড়াপ্রধান কারবারি অথবা মৌজাপ্রধান হেডম্যান অথবা সার্কেল-প্রধান রাজা। শহর এলাকার পাহাড়িরা ব্যতীত অন্যরা জমির ব্যক্তিগত মালিকানার পদ্ধতির সাথে নিবিড়ভাবে পরিচিত ছিলেন না। তৃতীয় বাস্তবতা, ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত সর্বদাই ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি জড়িত। অতএব, বাঙালিদের বসতি স্থাপন করে জমি দেয়ার সময় দুর্নীতি যে হয়নি, এ কথা কেউ শপথ করে বলতে পারবে না। এরূপ তিনটি বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে, বাঙালিদের অবস্থান কঠিন ছিল, অপ্রিয় ছিল, ঝুঁকিপূর্ণ ছিল কিন্তু অপরিহার্য ছিল। সেনাবাহিনীর শক্তি যথেষ্ট না থাকায় সেটেলার বাঙালিদের বা পাহাড়ি গ্রামগুলোকে উপযুক্ত নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হতো না। বাঙালিদের চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি সমস্যাও চরমভাবে অবহেলিত থেকে যায়। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৮৬ সালে একবার এবং আরেকবার ১৯৮৮ সালে বাঙালিরা মারাত্মক ও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। আদি বাঙালি বেশি ছিল বান্দরবান জেলায়, তার পরে ছিল রাঙ্গামাটি জেলায় এবং সবচেয়ে কম ছিল খাগড়াছড়ি জেলায়। নতুন বসতি স্থাপন করা বাঙালিরা সংখ্যায় বেশি হয়েছে খাগড়াছড়ি জেলায়, তার পরে হয়েছে রাঙ্গামাটি জেলায় এবং তার পরে হয়েছে বান্দরবান জেলায়। ১৯৮৮ সালে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ এবং তৎপরবর্তী সরকারের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সম্বন্ধে গত সপ্তাহের (১৮ মার্চ) কলামে লিখেছি। কলামটির নাম ছিল ‘রাজনীতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পর্ক নিয়ে বোঝাবুঝি’। কলামটি আমার ওয়েবসাইটে পাবেন। অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওয়েব সাইটে আর্কাইভসে পাবেন।

শান্তিবাহিনী কী চাইত?
শান্তিবাহিনী কী চাইত সেটা যদি আমরা না জানি, তাহলে এখন কী চায়, এর মূল্যায়ন কিভাবে করব? ১৯৮৮ সাল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলায় কথা আছে- ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা শক্ত হবো। জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনী যা চায় তার প্রতি কোনো প্রকার নমনীয়তা দেখানো যাবে না। এই পর্যায়ে সম্মানিত কলাম পাঠকের মনে, নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন আসবে, শান্তিবাহিনী কী চাইত? শান্তিবাহিনী তখন যা চাইত, আজো যে তা চায় না সেটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব না। এখন পর্যন্ত, অব্যাহতভাবে শান্তিবাহিনী যা যা প্রকাশ্যে চেয়ে আসছে, তার মধ্যে এক নম্বর হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো বাঙালি বসতি থাকতে পারবে না (অর্থাৎ ১৯৭১-এর পরে যারা গিয়েছে, তারা থাকতে পারবে না)। শান্তিবাহিনী যা চেয়ে আসছে, তার মধ্যে দুই নম্বর হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে অন্য কোথাও কোনো সেনা ক্যাম্প থাকতে পারবে না। তিন নম্বর হলো, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আদিবাসী’ ঘোষণা করতে হবে। এই তৃতীয় চাওয়াটি সাত বছর আগে যোগ হয়েছে। তবে এই তিনটি চাওয়ার ব্যাখ্যায় না গিয়ে পাঠককে ১৯৮৮ সালে ফেরত নিয়ে যাই। ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে বিদ্রোহ শুরু করার পর থেকে, বারো বছরের মাথায়, ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে প্রথমবারের মতো শান্তিবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দাবিনামা বাংলাদেশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। দাবিনামাটি আমার হাতেই দিয়েছিল কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করিনি। সেই দাবিনামায় পাঁচটি দফা ছিল এবং প্রত্যেকটিতে অনেক উপ-দফা ছিল। শান্তিবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে কী চাইত, এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য আমার লেখা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ নামে বইয়ের ২১৩ থেকে ২১৭ পৃষ্ঠায় আছে। আজকে বাঙালিদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছরের তরুণ বয়সের যারা কলাম পাঠ করছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগই এই দাবিনামা সম্বন্ধে অবহিত না থাকার সম্ভাবনা। কিন্তু তিনটি পার্বত্য জেলায় উপজাতীয় ভাইবোনদের মধ্যে যাদের বয়স পনেরো-ষোলো বছর থেকে শুরু করে ষাট বছর পর্যন্ত এবং একটু লেখাপড়া জানেন- এমন সবাই, এই দাবিনামাগুলোর মধ্যে প্রধান দিকগুলো মুখস্থ বলতে পারার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। উপজাতীয় জনগণ যে জানে, এটা তাদের প্লাস পয়েন্ট। বাঙালি তরুণেরা যে জানে না, এটা তাদের মাইনাস পয়েন্ট। ওই পাঁচ দফা দাবির মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দাবির সারমর্ম ছিল এ রকম- (এক) বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রে দু’টি প্রদেশ হবে। একটি প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ, রাজধানী ঢাকা। আরেকটি প্রদেশের নাম হবে জুম্মল্যান্ড, রাজধানী রাঙ্গামাটি। দু’টি প্রদেশ মিলে একটি ফেডারেশন হবে। যেই ফেডারেশনের নাম হবে বাংলাদেশ এবং ফেডারেশনের রাজধানী হবে ঢাকা। তিনটি বিষয় যথা দেশরক্ষা, বৈদেশিক মুদ্রা ও ভারী শিল্প ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে; বাকিগুলো থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। (দুই) প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাই ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে বা শাসনপদ্ধতিতে যেন কোনো পরিবর্তন আনা না হয়, এর সাংবিধানিক গ্যারান্টি চাই।

আমি বা আমরা কী করতে পারি?
ওই আমলের সরকার (এরশাদ সরকার) সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, এ দাবিগুলো মানা যাবে না। অতএব, বিকল্প কার্যকর পন্থা শুরু করো। আজ ২০১৫ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ওই দাবিনামা মানবেন কি না, সেটা তাদের বিষয়। ওই দাবিনামা মানা না হলেও, গত পনেরো-বিশ বছরের সরকারি অবহেলার কারণে, শান্তিবাহিনী ওই দাবি আদায়ের বিকল্প রাস্তা আবিষ্কার করেছে। এর বহিঃপ্রকাশ অহরহ ঘটছে, স্থানাভাবে বিস্তারিত বললাম না। আমার মূল্যায়ন ছিল, এরূপ ঘটনা ঘটবেই। অতএব, সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির নিমিত্তেই, আমার দায়িত্বের অংশ হিসেবে আগেই দু’টি এবং আজকেরটি নিয়ে মোট তিনটি কলাম লেখা। আমি যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেই, আর কী-ইবা করতে পারি? অনুগ্রহপূর্বক, আগামী বুধবারের ও তার পরের বুধবারের কলামের অপেক্ষায় থাকুন। এরপর কয়েক দিন লিখতে পারব না মনে হয়।

লেখক : মেজর জেনারেল অব: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন