পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে সেনাবাহিনীতে ‘ইজ্জতের রশি’ দেখলাম

আ ল ম ফজলুর রহমান

(দশ)

দুমদুমিয়া থুমে যাত্রার জন্য অপারেশনাল পেট্রোল প্রস্তুত এডজ্যুটেন্ট আমাকে রিপোর্ট দিলো। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার দেওয়া সময়ের মধ্যেই দুমদুমিয়া থুমে ক্যাম্প করতে যাওয়া অপারেশনাল পেট্রোল রেডি হয়ে যাত্রার জন্য তৈরী। বুঝলাম এই ব্যটালিয়ানের অপারেশনাল ক্যাপাবিলিটি পারফেক্ট অবস্থায় আছে। কারণ আর্মিতে প্রত্যেক কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেধেঁ দেয়া আছে। যদি সেই কাজ সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব না হয় তবে বুঝতে হবে প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। এটা খুব গুরুত্বপুর্ন একটি বিষয়। আর বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো অপারেশনাল এরিয়াতে এর কম্প্রোমাইজের কোনো সুযোগ নাই। সেনাবাহিনীতে যা করা সম্ভব তার বাস্তবায়নে আপারগতার কোনো স্কোপ নাই। কারণ এটা একটা জীবন মরণের প্রশ্ন।

এজন্যই সেনাবাহিনীর প্রত্যেক প্রশিক্ষণ মাঠে লক্ষ্য করলে দেখবেন বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে, ঘাম রক্ত বাঁচায়। আরো লেখা থাকে, কঠিন প্রশিক্ষণ সহজ যুদ্ধ। অর্থাৎ কঠিন প্রশিক্ষণে যদি বেশী করে ঘাম ঝরানো যায় তবে সৈনিকরা যুদ্ধের মাঠে পারদর্শিতার সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবার ফলশ্রুতিতে রক্ত কম ঝরে । অর্থাৎ যুদ্ধে হতাহত কম হয়। সহজে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। তবে প্রশিক্ষণেই শেষ কথা নয়। সেনাবাহিনীর মুল চালিকা শক্তি হলো কমান্ড এবং আদেশ। এই কমান্ড এক ব্যক্তি নির্ভর একটি অবিভাজ্য অব্যয়। সেনাবাহিনীর এই কমান্ড শেয়ার করার কোনো স্কোপ নাই। এই কমান্ডের দ্বারা সেনাবাহিনীর ধ্রুপদী মৌলিক বিষয় সমন্বিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। তা প্রশিক্ষণ হোক বা যুদ্ধ প্রস্তুতি হোক বা যুদ্ধ হোক। এর অন্তর্গত সব মৌলিক বিষয় কমান্ডের দ্বারা সমন্বিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। অতএব এই কমান্ড শেয়ার করা সম্ভব যেমন নয় তেমনি এটি একটি অবিভাজ্য অব্যয়।

একজন কমান্ডার সবার মতামত শুনবেন তবে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাই সেনাবাহিনীর কমান্ডে তাদেরকেই বসানো হয় যারা সাহস, প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতায় পারঙ্গম। সেনাবাহিনীর অন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ বিষয় হলো আদেশ । এই আদেশের ইন্টারপ্রেটেশন সাধারণ আদেশের মতো করে করা যায় না। যেমন শত্রুর একটা অবস্থান দখল করতে হবে। কমান্ডার তাঁর অধীনস্ত কমান্ডারদের ডেকে এই আদেশ দিতে পারেন না যে, দেখ আমাদের শত্রুর একটি পোস্ট দখল করতে হবে তোমারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ওটা দখল করো। সেনাবাহিনীতে এমন আদেশ শুধু আত্মঘাতীই নয় এটা কমান্ড ফেইলিয়রের নামান্তর।

আদেশ সামরিক কমান্ডের একটা অবিভাজ্য অংশ। আদেশ কমান্ডার কর্তৃক দেওয়া হবে এবং তা ক্লিয়ার, কোনো এম্বিগুয়েটি ছাড়া স্পেসিফিক ভাবে দেওয়া হবে যাতে আদশ সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ না থাকে।

এই জন্যই আমি দুমদুমিয়া থুমে অপারেশনাল পেট্রোলের যাত্রার সময় বেঁধে দিয়েছিলাম আমার কমান্ড এবং আদেশের অংশ হিসাবে। যখন দেখলাম পেট্রোল সময় মতো প্রস্তুত হতে পেরছে তখন বুঝলাম এই পেট্রোল সময়মতো দুমদুমিয়া থুমে পৌঁছে ক্যাম্প স্হাপনে সক্ষম হবে। যখন কোনো সামরিক ভিআইপিকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় তখন তিনি গার্ড পরিদর্শনের সময় একজন গার্ডের পা থেকে অর্থাৎ পায়ে পরা বুট প্রথমে পরিদর্শন করেন। পরে ধীরে ধীরে সৈনিকের বেল্ট, তার ইউনিফর্মের বোতাম, ক্রিজ, কলার ঠিক মতো উল্টানো আছে কিনা, সৈনিকের সেভিং, মাথার ক্যাপ, ব্যারেট ঠিক মতো পরা আছে কিনা, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি এবং তার অস্ত্র ঠিক মতো ধরা ধরা আছে কিনা দেখেন ।

আর্মিতে একটি প্রবাদ আছে যে, সৈনিকের বুট পরিষ্কার করে কালি করা, ঝকঝকে তকতকে থাকলে বুঝতে হবে ঐ সৈনিকের আন্ডার ওয়্যার যেমন পরিষ্কার আছে তেমনি তার পার্সোনাল ডিসিপ্লিনও ঐ বুটের মতো সুন্দর। তো আমি পেট্রোলের সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম দশজন করে সৈনিকের একটি দল গঠন করা হয়েছে। মাঝখানে আট/ দশ জন করে পোর্টার রেশন এবং অন্যান্য সামগ্রী বহনের জন্য দণ্ডায়মান এবং লাইন ব্যাডাং দিয়ে একে অন্যের সাথে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এটা এইজন্য করা হয়েছিলো যে ঐদিন আপার হিলে বৃষ্টির ফলে রেংখিয়াং খালের পানি ধীরে ধীরে বেড়ে উঁচু হচ্ছিল এবং স্রোতের তোড় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ফলে শুক্করছড়িতে রেংখিয়াং খাল পার হবার সময় কোনো পোর্টার যাতে ভেসে না যায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা।

তদুপরি পথ চলার সময় অসাবধানতা বশতঃ কোনো পোর্টার পাহাড়ী খাদে পড়ে যেন আহত না হয় তার প্রিকশন হিসাবে লাইনব্যডিং এর রশির ব্যবহার করা হয়েছিলো। আমি লক্ষ্য করলাম প্রত্যেক অস্ত্রের নজালে একটি বাঁশের ডান্ডার সাথে নায়লনের চিকন দড়ি প্যাচানো বেঁধে রাখা। আমি এডজ্যুটেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কেন এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। বললো, স্যার এটার নাম ইজ্জতের রশি। ইজ্জতের রশি মানে? এটা পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনে নিয়োজিত সবার জন্য অস্ত্রের মাথায় বেঁধে রাখা বাধ্যতামুলক যাতে কোনো অস্ত্র পানিতে কিংবা জঙ্গলে পাহাড়ের খাদে পড়ে হারিয়ে না যায়। যদি কোনো সময় অসাবধানতাবশতঃ পড়ে যায় তবে ইজ্জতের রশি ধরে যেন তা সহজে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বুঝলাম যুক্তির কথা। এই রশি সবার ইজ্জত রক্ষা করে বলে সম্ভবতঃ এর নাম ইজ্জতের রশি হয়ে থাকতে পারে। তবে কে এই রশির ব্যবহার প্রথম করেন এবং কে এই রশির নাম ইজ্জতের রশি দিয়েছিলো আজও আমি জানতে পারি নাই।

রাত প্রায় আটটার সময় পেট্রোল টুআইসি মেজর কাদেরের নেতৃত্বে দুমদুমিয়া থুমের পথে যাত্রারম্ভ করলো। মেজর কাদেরের সাথে সহযোগী অফিসার হিসাবে গলো লেফটেন্যান্ট কাজি হালিমুর রশীদ ( লে: কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত ) ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রেজাউর রহমান, ( মেজর জেনারেল এলপিআর ভোগরত ) তিন জন জেসিও এবং ছয় জনের মতো এনসিও ।

চলবে…

মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর


এই ধারাবাহিকের আগের লেখাগুলো পড়ুন

  1. ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার অভিজ্ঞতা

  2. ♦ জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে পোস্টিং করেন

  3. ♦ বঙ্গবন্ধু আর্মি অফিসার মেস থেকে মদের বার তুলে দেন

  4.  ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরে প্রথম দিন 

  5.  পাহাড় পথে হাঁটার প্রথম অভিজ্ঞতা হলো

  6.  সব হেডম্যানের সাথে শান্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে

  7.  পাহাড়ীরা সর্বভূক এমন কিছু নাই যে খায় না

  8. ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামের চিনা জোঁকের আক্রমণ একটা মহাসমস্যা

  9. ♦ সাবেক সেনাপ্রধানের`মঈন ইউ আহমেদ’ নামটি আগে ছিলো না এটি সে পরে গ্রহণ করেছে

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন