পার্বত্য চট্টগ্রামে অবকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে বাড়ছে বাণিজ্য

সম্ভাবনার পাহাড়- ৬

আলীকদম- থানচি রোড

জাহিদুল ইসলাম, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:
আয়তনের বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক। ৭০২ বর্গমাইল আয়তনের এ ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ২৫৮ একর জমিতে কমলা চাষ হয়। আকার ও স্বাদে অনন্য এ কমলা কয়েক বছর আগেও বিক্রি হয় পানির দরে। কারণ সাজেক থেকে অনেক পথ হেঁটে কাপ্তাই হয়ে নৌপথে রাঙ্গামাটি যেতে হয়। দুর্গম এ পথে পণ্য পরিবহন না হওয়ায় বরাবরই গাছে নষ্ট হয়েছে পাকা কমলা। সময়ের ব্যবধানে সাজেকেও কমলা বিক্রি হচ্ছে সমতলের প্রায় সমান দামে।

সেনাবাহিনীর প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়নের (ইসিবি) তৈরি করা ৩৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর বাঘাইহাট-মাসালং-সাজেক সড়ক বদলে দিয়েছে সেখানকার মানুষের ভাগ্য। এ সড়কের সুবাদে সাজেকের যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে অবকাঠামো উন্নতির সঙ্গে বাড়ছে বাণিজ্য। উন্নতি হচ্ছে আর্থিক অবস্থার।

সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগগুলো বদলে দিচ্ছে মানুষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। একটি সড়কের সুবাদে সাজেক এখন দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটনগুলোর অন্যতম। এখানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় মিলে প্রায় অর্ধশত রিসোর্ট। কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক মানুষের। এরই ধারাবাহিকতায় কমে এসেছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জুম চাষ। তামাক চাষের প্রবণতাও অনেক কমেছে।

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দর উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চারটি বন্দর উন্নয়নে প্রস্তাবিত এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫৯৬ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪৩৩ কোটি টাকা ঋণ দেবে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। অবশিষ্ট ১৬৩ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে ৪০০ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ির রামগড় বন্দর উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আরও বাড়বে। ফলে পার্বত্য এলাকার তিন জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী দিপংকর তালুকদার এ বিষয়ে আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে পার্বত্য এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটছে না। পাহাড়ের বিভিন্ন ফল ও ফসল ঘিরে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় বিদ্যুতের উন্নয়নে বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পার্বত্য এলাকা শিল্প ও বাণিজ্যে অনেক অগ্রসর হবে বলে তিনি মনে করেন।

জানা যায়, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার সাড়ে ৩৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭৪ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বান্দরবান জেলার অবস্থান।

এ জেলার সঙ্গে অন্যান্য উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের জনগণের জীবনমান আশানুরূপ নয় এবং গড় মাথাপিছু আয় জাতীয় আয় হতে কম। শিক্ষা সুবিধা ও স্থাপনার অপর্যাপ্ততার কারণে আলীকদম উপজেলার দক্ষিণে বসবাসরত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার কম।

ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডাক্তারের অপ্রতুলতার কারণে মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্চিত। এসব মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয়রা আলীকদম উপজেলার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষাকালে স্থানীয়দের উপজেলা সদরে পৌঁছতে দীর্ঘসময় লাগে।

প্রস্তাবিত সড়কটি নির্মিত হলে এ অঞ্চলের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে এ সড়কটি দুর্গম অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং নিরাপত্তা অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একাধিক জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সারা দেশে ৩৬ হাজার ৪৪৭ একর জমিতে আদার চাষাবাদ হয়। এর মধ্যে পার্বত্য তিন জেলায় আদা চাষ হয় ১৮ হাজার ৭২৭ একর জমিতে। অবশিষ্ট ৬১ জেলায় আদা চাষের আওতায় রয়েছে ১৭ হাজার ৭২০ একর জমি।

সারা দেশে ৭৭ হাজার ৮৩৭ একর জমিতে হলুদ চাল হলেও পার্বত্য এলাকায় মশলাটির চাষ হয় ২৯ হাজার ৪৪৭ একর জমিতে। পার্বত্য এলাকায় কলা চাষের আওতায় রয়েছে ৩৯ হাজার ১৮৪ একর জমি। এর বাইরে আনারস, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ হয় পার্বত্য অঞ্চলে। সমতলের তুলনায় পাহারে এসব ফসল উৎপাদনে ব্যয়ও কম। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতিতে চাষিরা এসব পণ্যের নায্য দাম পাচ্ছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করছে।

পার্বত্য এলাকায় শিল্পায়নে বিদ্যুৎ সমস্যাকেই সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসেবে ৩ জেলার ২৬ উপজেলায় বিদ্যুতের গ্রাহক আছেন ৮৬ হাজার ৫৬৪ জন। এখানে সরবরাহ করা বিদ্যুতের লাইনের ধারণক্ষমতা মাত্র ৯৯ মেগাওয়াট। কিছুদিনের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা উন্নীত হবে ২৭৯ মেগাওয়াটে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সমাদৃত এ পাহাড়ি এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও শিল্পায়নের সুযোগ কাজে লাগাতে পার্বত্য এলাকায় বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থায় উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে অবকাঠামোর উন্নয়ন, নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণ ও পুরনো উপকেন্দ্রের আধুনিকায়ন করা হবে। নতুন বিতরণ লাইন স্থাপনের পাশাপাশি সংস্কার করা হবে পুরনো লাইন।

বিশাল এ কর্মযজ্ঞে ৫৫০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় ১২টি নতুন ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ, চারটি বিদ্যমান ৩৩/১১ কেভি পুরনো সাবস্টেশন সংস্কার, ১৩১০ কিমি. নতুন বিতরণ লাইন স্থাপন ও ৩৪৬ কিমি. পুরনো বিতরণ লাইন সংস্কার করা হবে।

সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন