পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-পাহাড়ে বাঘের অস্তিত্ব

হোসাইন সোহেল

হাসান সোহেল

বান্দরবানের থানচি উপজেলা থেকে শঙ্খ নদীর কূল ধরে হেঁটে চলেছি আরো উঁচু পাহাড়ে। তিন দিন পর দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে দেখা মিলল ছোটমদক নামক জায়গাটির। এর আগে পুনর্বাসনপাড়াসহ রেমাক্রির আরো দুটি পাড়ায় কেটেছে দুই রাত। সারা দিন হেঁটে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, তখন তৃতীয় রাত। ছোটমদক থেকে আরো প্রায় দেড় হাজার ফুট ওপরে রেমাক্রি ইউনিয়নের সবচেয়ে উঁচু রুংশোলাপাড়াতে তৃতীয় রাতের আশ্রয় মিলল। সে রাতেই জানতে পারি, মাত্র তিন বছর আগে পাহাড়ের জঙ্গলে বাঘ শিকারের গল্পটি।

পঁয়ত্রিশ বছরের শক্ত-সমর্থ যুবক আলেকজেন্ডার ত্রিপুরার সঙ্গে কথা হলো রুংশোলাপাড়ার একটি টংঘরে। মিষ্টি হাসির মানুষটি দেখে বোঝার উপায় নেই, সে একজন বাঘশিকারি। সচরাচর শিকারিদের চেহারায় একটু ভাবগাম্ভীর্য থাকলেও সে ব্যতিক্রম।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ডকৃত সর্বশেষ পাহাড়ি বাঘটি ধরাশায়ী হয়েছে আলেকজেন্ডারের হাতে। তবে পাহাড়ে শুধু বাঘ নয়, অনেক প্রাণীই তিনি শিকার করেছেন পাড়াবাসীর খাদ্যের জন্য। রুংশোলাপাড়া থেকে পূর্ণিয়মপাড়া বেশি দূরে নয়। পাহাড়ের ঢালে জুম কাটতে (ধান চাষের আগে পাহাড়ের জঙ্গল কাটা বলে) আলেকজেন্ডার সঙ্গে নিয়েছিল তার শিকারি দুটি কুকুর (ত্রিপুরা ভাষায় কুকুরকে বলে সই)।

অন্যমিডিয়া

এক বিকেলে আলেকজেন্ডার বসেছিল জুমঘরে (বিশ্রামের অস্থায়ী ঘর)। হঠাৎই সে তার কুকুরের মৃত্যুচিৎকার শুনতে পায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় কুকুরটিরও একই অবস্থা। এমন অবস্থায় তার শিকারি মন বুঝতে পারে, একটি বড় বাঘের মাথা জঙ্গলের আড়ালে রয়েছে।

আলেকজেন্ডার সময় নষ্ট করেনি। নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত রাইফেলের একটি গুলি যথেষ্ট ছিল বাঘটিকে ধরাশায়ী করতে। উভয়ের দূরত্ব কম থাকায় বাঘটি পালানোর সুযোগ পায়নি। অবশেষে কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করে সে নিশ্চিত হয়, বাঘটি নড়াচড়া করছে না। আলেকজেন্ডার তার দুটি কুকুর হত্যার প্রতিশোধসহ রুংশোলাপাড়ার ৩৮টি পরিবারের সদস্যদের মুখে মাংস তুলে দিতে পারবে বলে আরো উচ্ছ্বসিত হলো। কিন্তু বিপদ হলো, সে তো একা বাঘটি বহন করে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই পাড়াতে ফিরে কয়েকজন যুবকের সহযোগিতায় মৃত বাঘটি চলে এলো রুংশোলাপাড়ায়।

এমন গোছানো গল্প আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তারপরও শুনতে চাই পরের ঘটনা। ছোটমোদকের রুংশোলাপাড়া শুধু নয়, বড় জীবজন্তুর শিকারের ঘটনা আশপাশের পাড়াতেও নাড়া দেয়। পাড়াতে যখন মৃত বাঘ এলো, তখন পাড়াবাসী সবাই এসে হাজির সন্ধ্যার আঁধারে কুপিবাতি হাতে।

আলেকজেন্ডার ত্রিপুরা আগেও একটি বাঘ শিকার করেছিল। ২০০৮ সালে, অর্থাৎ সাত বছর আগে হাড় ছাড়া ৫৭ কেজি ওজনের বাঘটির চামড়াও পুড়ে খেয়েছিল পাড়াবাসী। তবে এবার চামড়া পুড়িয়ে খেতে রাজি নয় কেউ। সাত ফুট লম্বা চামড়াটি পাড়াবাসী সংরক্ষণ করতে চায় শিকারের স্মৃতি হিসেবে। পূর্ণিয়মপাড়ায় মাঝারি আকারের বাঘটির চামড়া ও হাড় বাদে মাংস পেয়েছে কমপক্ষে ৩৫ কেজি।  মাংস বা হাড় খাওয়া শেষে কাটাছাঁটাহীন চামড়া রোদে শুকিয়ে নতুন একটি বাঘ (স্টাফড) তৈরি করে আলেকজেন্ডার। চামড়ার ভেতর জুম ধানের খড়কুটো ঢুকিয়ে দাঁড় করানো বাঘটি সাজিয়ে রাখে নিজ ঘরে। মাসখানেক না যেতে একদিন মিয়ানমারের চার সদস্যের একটি দল এসে হাজির তার বাড়িতে। তারা বাঘটির চামড়া, দাঁত, নখ সব কিনে নিতে চায়।

দুর্গম পাহাড়ের মানুষগুলো একেবারে দরিদ্র। তাদের কাছে একশ টাকা মহামূল্যবান। সে সুযোগে আলেকজেন্ডারের হাতে দেওয়া হলো তিন হাজার ৫০০ টাকা। বিনিময়ে বাঘের সাত ফুট লম্বা সেই চামড়া, দাঁত ও নখ চলে যায় মিয়ানমারের দলটির দখলে।

এমন গল্পের যখন শেষ, তখনো কোনো বস্তুগত প্রমাণ আমার হাতে আসেনি। এর পরও রাতের আঁধারে পাড়াপ্রধান রুংশোলা কারবারি বীরেন্দ্র ত্রিপুরাসহ কয়েকজনের উপস্থিতিতে তার এই বক্তব্য অবশ্য বাস্তবতার একেবারে কাছাকাছি।

পরদিন সকাল ৭টা। ঘুম থেকে উঠে নজরে আসে টংঘরের বাঁশের দেয়াল। গত রাতে কুপিবাতির আলোয় যে ঘরে শুনেছি বাঘ শিকারের গল্প, সে ঘরের দেয়ালে সাটানো রয়েছে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমের জীবজন্তুর ছবি আঁকা একটি পোস্টার। তার মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের বেঙ্গল টাইগারের আঁকা ছবিসহ অন্যান্য বিড়াল প্রজাতির ছবিও।

আলেকজেন্ডারকে সর্বশেষ জিজ্ঞাসা, এই ছবির বাঘটি তার শিকারের বাঘ কি না। যার গায়ে রয়েছে ডোরাকাটা কালো দাগ, রয়েছে সারা শরীরে সাদা-কমলা রং মেশানো। তার সব উত্তর হ্যাঁ হলো। মনের মধ্যে খচখচানো থাকলেও এবার বিশ্বাসের নিশ্বাস এসে থেমে দাঁড়ায়। সত্যিকারের বাঘটি ছিল বেঙ্গল টাইগার ইংরেজদের ভাষায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার!

গত রাত থেকে অনর্গল বলে যাওয়া গল্প যেন বিশ্বাস করতে চাইছি না। এর পর আবারো পোস্টারে বাঘটির চিত্র দেখিয়ে সত্যতা জানতে চাওয়াতে আলেকজেন্ডার বোধ করি একটু মন খারাপ করল। শত হলেও সে শিকারি।

শিকারিদের জেদ বোধ করি একটু বেশি। এবার সে দেরি না করে তার ছোট ছেলের গলা থেকে খুলে নিয়ে আসা দাঁতটিও আমার চোখের সামনে তুলে ধরল। শুধু দাঁত নয়, পেশাগত জায়গা থেকে আলেকজেন্ডারের বাঘ শিকারের গল্পটি ভিডিও ক্যামেরাতে ধারণ করলাম।

এভাবে আরো সাত দিন চলে পাহাড় পরিক্রমা। এর পর বান্দরবান থেকে ঢাকা এসে পাহাড়ের বাঘ নিয়ে গবেষণারত সুপ্রিয় চাকমাকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ, প্রাণীবিদ ড. আনিসুজ্জামান খানসহ আরো কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে পুরো বিষয়টি জানালাম। কারণ, আমার সংশয় বা জানার সংকট কিংবা পরিবেশ সাংবাদিকতার কোনো ভুল বিষয়বস্তু কাউকে জানাতে চাই না।

ফিরে আসার পর আমার সন্দেহ দূর করতে উপরে উল্লিখিত বাঘের মাংস পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। উত্তরও পেলাম বাংলার বাঘ বা চিতা ছাড়া বিড়াল প্রজাতির অন্য কারো দেহে হাড় ছাড়া এত মাংস হওয়ার কথা নয়। সে অনুযায়ী বাঘের আকারটি হতে পারে মাঝারি আকারের।

যাই হোক, প্রাণীবিদদের বক্তব্য স্পষ্ট, বাংলার বাঘ শুধু সুন্দরবন নয়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় এখনো রয়েছে। পাহাড় বা সুন্দরবন বলে কথা নয়, দুটো একই বাঘ। তবে তাদের আবাসস্থল ভিন্ন। পাহাড়ে অনেক আগে থেকে বাঘ তো ছিলই, সে সঙ্গে ছিল ঘন অরণ্য। মিয়ানমার বা বাংলাদেশে যেটাই হোক, এই বাঘগুলোর যাতায়াত উন্মুক্ত ছিল। তবে বাঘ শিকার, ঘন জঙ্গল কেটে ফেলা, খাদ্যসংকটসহ বসবাসের উপযোগিতা কম, তাই পাহাড়ে বাঘের পরিমাণও কম।

বাঘ বিলুপ্তির প্রথম কারণ, শিকার আর দ্বিতীয় বড় কারণ হলো খাদ্যসংকট। একটি পূর্ণাঙ্গ বাঘের বছরে ৫০টি বড় হরিণের (সাম্বার) সমান খাবার দরকার হয়। যার মাংসের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার কেজি। কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে প্রতিটি বাঘের জন্য তাই ৫০০টি বড় জন্তু বা বড় হরিণের দরকার হয়।

আলেকজেন্ডারের বাঘ শিকার নতুন বিষয় নয়, এর আগেও বাংলাদেশের পাহাড়ে শিকার হয়েছে অনেক বেঙ্গল টাইগার। তবে ২০০৮ সালসহ আলেকজেন্ডারের তিন বছর আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালের বাঘ শিকারটি ছিল এ সময়ের সর্বশেষ বাঘ শিকার। এর পর তিন বছরের মধ্যে পাহাড়ে এখন পর্যন্ত আর কোনো বাঘ শিকারের ঘটনা শোনা যায়নি। এর আগে ২০০৩ সালে কাসালং সংরক্ষতি বনে দুটি ও ২০০৬ সালে রেমাক্রি খালে একটি বাঘ হত্যার রেকর্ড নথিভুক্ত ছিল। অন্যদিকে ২০০৯ সালে রাইংখং সংরক্ষিত বনে একটি জীবন্ত বাঘের দেখা মিলেছিল। আর তাই বলা যায়, পাহাড়ে বাঘ একেবারে হারিয়ে যায়নি।

পাহাড়ের শুধু বাঘ শিকার নয়, অসংখ্য জীবজন্তুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যুগ যুগ ধরে বেচাকেনা হয়েছে সীমান্তের এপার-ওপার। মিয়ানমারের চার সদস্যের যে দলটি আলেকজেন্ডারের বাঘের চামড়াটি নিয়ে গেছে, তার বাজারমূল্য অনেক চড়া। অথচ আলেকজেন্ডারের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায়। আর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাঘের পায়ের নখ ও দাঁত। যার বাজারমূল্য অনেক।

বাংলাদেশ বন বিভাগের পাহাড়ের বনজ বা প্রাণিজ সম্পদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। কারণ, তাদের পরিকল্পনা নেই। পাহাড়ে গভীরে নেই কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি। বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সব তহবিল তাই ঢেলে দিতে চায় সমতলভূমিতে। অথচ পাহাড়ের মানুষকে সচেতন করতে পারলে দিন শেষে তারাই অনেক বেশি সহনশীল সংরক্ষণবাদীতে পরিণত হতে পারতেন।

লেখক : পরিবেশ ও বন্য প্রাণীবিষয়ক সাংবাদিক।

সূত্র: এনটিভিবিডি

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, পাহাড়, বন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন